স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এবং পরবর্তীতে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ সবসময় স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করে এসেছে। কখনো নতজানু ও মেরুদন্ডহীন নীতিতে পথ চলেনি। এর সুফল যেমন আছে, তেমনি পরাশক্তিগুলোর বিরাগভাজন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে টানতে এবং নিজেদের ভূ-রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্রমাগত। তবুও ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্রনীতি পুঁজি করে নিরপেক্ষ অবস্থানে চলছে বাংলাদেশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ২য় শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য (একক দেশ হিসেবে প্রথম)। বাংলাদেশেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট FDI (Foreign Direct Investment) বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে IPS (Indo-Pacific Strategy), QUAD (Quadrilateral Security Dialogue), IPEF (Indo-Pacific Economic Framework), AUKUS (Australia–United Kingdom–United States) ইত্যাদি বিভিন্ন ফোরাম ও কর্মসূচির মাধ্যমে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। বাংলাদেশ এখানে একটি বার্গেইনিং পজিশনে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ থেকে স্বল্পমূল্যে তৈরি পোষাক কেনে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ এই খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। প্রায় ১৫.৬২% শুল্ক দিতে হয়। তবুও ক্রয়াদেশ প্রচুর। সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার ভারসাম্যের জন্যই মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন সময় ভিসানীতি ও শ্রম অধিকার নিয়ে নানারকম চাপ দিলেও, কার্যত বাংলাদেশকে নতজানু করতে সক্ষম হয়নি।
এ বছরের ১৮ই মে Stimson Centre-এর পলিসি পেপার্সে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ইস্যুতে চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে উল্টো বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান আরও নড়বড়ে করেছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিগুলোর এতে সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে মার্কিন নীতির প্রয়োগ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে বাইডেন সরকার। যা এক লজ্জাজনক পরাজয়।
চীন
চীন বাংলাদেশের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। বৈদেশিক ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় চীন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুরাষ্ট্র। আবার চীনের জন্য বাংলাদেশও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘মালাক্কা ডিলেমা’ (মালাক্কা প্রণালী দিয়ে আমদানি-রপ্তানি রুট বন্ধের ভয়] চীনের পুরনো। যার বিকল্প হিসেবে বঙ্গোপসাগর চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি চীন বাংলাদেশে শীর্ষ রপ্তানিকারক। যেকোনো পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল, সামরিক সরঞ্জামসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তারা বাংলাদেশে। এদেশে চীনের একটি বড় ভোক্তাবাজার রয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশের বৃহৎ সহযোগী চীন। পদ্মাসেতু, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চীন অত্যন্ত সুবিধাজনক শর্তে অর্থায়ন ও বিনিয়োগ করেছে, করছে। BRI (Belt and Road Initiative), GDI (Global Development Initiative), GSI (Global Security Initiative), Pearl Trade Policy, Flagship Policy, RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) ইত্যাদির জন্য বাংলাদেশ চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানেও বাংলাদেশ বার্গেইনিং পজিশনে রয়েছে।
ভারত
ভারতও বাংলাদেশের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। ভারত তার উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করা হয় ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও তাদের জন্য বিদেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে অস্ত্র এনে ভারতের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা চালানোর সুযোগ করে দিতে। মূলত জঙ্গিরাষ্ট্র পাকিস্থানের বুদ্ধি-পরামর্শে খালেদা জিয়া সরকার এই কাজটি করেছিল। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়ে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করেন। ফলে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে শান্তি ফিরে আসে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ধরা পড়ে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ এই বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করে। ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণ সবসময় এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, বাংলাদেশের অবদান স্বীকার করেছে। বাংলাদেশও এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার সুবাদে বিভিন্ন সময় সুবিধা পেয়েছে। পরাশক্তি ভারতের সাথে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। অথচ এই ভারতের সাথে তাদের অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ-বিবাদ লেগেই রয়েছে। বন্ধুসুলভ সম্পর্ক রাখার কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্থিতিশীল।
এছাড়া ২০১০ সালে ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি হয়। এই ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ও বঙ্গোপসাগরে ভূকৌশলগত কারণে ভারতের কাছে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অগ্রাধিকার পায়। করোনা মহামারির সময় ভারত থেকে প্রচুর মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট সহযোগিতা এসেছিল বাংলাদেশের জন্য। ডলার সংকট ও একক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে দুদেশের মাঝে ২০২৩ সালের ১১ই জুলাই রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। যাতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাই বেশি। কারণ, ভারতের রিজার্ভে ডলারের প্রাচুর্য থাকলেও বাংলাদেশের জন্য রুপিতে বাণিজ্য করা স্বস্তিদায়ক বেশি।
বাংলাদেশে ভারতের দুটি ইকোনমিক জোন রয়েছে এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে CEPA (Comprehensive Economic Partnership Agreement) বাস্তবায়নে কাজ করছে উভয় দেশ। বাংলাদেশেও ভারতের বড় ভোক্তাবাজার রয়েছে। ভারত ২য় শীর্ষ রপ্তানিকারক। চীনের প্রভাব হ্রাসেও বাংলাদেশকে পাশে চায় ভারত। অর্থাৎ দুদেশেরই স্বার্থ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে সদস্যপদ পেতে বাংলাদেশ ভারতের সহযোগিতা নেয়। অনেকে অপব্যাখা করেন, বাংলাদেশ ভারতের অনুগত রাষ্ট্র। যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। বাংলাদেশ মূলত নিজ স্বার্থ ও অগ্রযাত্রায় কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করছে। ভারত কিংবা ভারতের মাথাব্যথার কারণ চীন- কারো ওপর একক নির্ভরতা নেই বাংলাদেশের। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সুসম্পর্ক দুদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জাপান
জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের শুরু বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের পর দুদেশের মাঝে সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই সম্পর্ক ঝিমিয়ে পড়ে। তবে শেখ হাসিনা সরকার ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্ককে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে নিয়ে যান পুনরায়। ফলে বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক নিঃস্বার্থ বন্ধুর মতই। বিভিন্ন সময় জাপান বাংলাদেশকে বহু সহযোগিতা দিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে দুদেশের বাণিজ্যিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশে BIG-B (The Bay of Bengal Industrial Growth Belt) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাপান। গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল নির্মাণ, মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেলে জাপানি বিনিয়োগ রয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজ করতে আসা জাপানি প্রকৌশলীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় হলি আর্টিজান হামলার সময়। সবাই ভেবেছিল জাপান হয়ত এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়াবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানে জাপানি নাগরিকরা আশ্বস্ত হন। সেই সাথে নিহত জাপানি প্রকৌশলীদের পরিবার এবং জাপান সরকারের প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও সাধারণ জনগণের আবেগাপ্লুত সহমর্মিতা দেখে জাপান সরকার নড়েচড়ে বসে। শোক সামলে নিহতদের পরিবারও জানান, তারা বাংলাদেশের পাশে আছে। জাপান সরকার জানান দেয়, বাংলাদেশে মেট্রোরেলের কাজ তারা সম্পন্ন করবেন। যদি জঙ্গি হামলার কারণে পিছিয়ে যান তারা, তবে জঙ্গিদেরই জয় হবে। জাপানের মানুষ এটা চায় না। এরপরই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে জাপান মেট্রোরেল প্রকল্পটি সম্পন্ন করে। শুধু তাই নয়, সড়ক ও সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ বাঁচিয়ে উদ্ধৃত অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে ফেরত দেওয়ার অনন্য নজির স্থাপন করে দেশটি।
এখানে উল্লেখ্য, পদ্মাসেতু প্রকল্পে জাইকার (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) অর্থায়নের কথা ছিল। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আজগুবি গল্প শুনে জাইকা পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই দুর্নীতির অভিযোগ ভুয়া প্রমাণ হলে জাইকা কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পারে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল পরবর্তী সময়ে। যদিও বাংলাদেশ সরকার অতীত ভুলে একসাথে কাজ করছে বিভিন্ন প্রকল্পে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানের জন্য ইকোনমিক জোন করা রয়েছে। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি হয় জাপান থেকে।
আবার জাপানি ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং কারখানা স্থাপনে আগ্রহী বলে দিন দিন জাপানের সাথে অংশীদারিত্ব বাড়ছে বাংলাদেশের। জাপানকে দেওয়ার চেয়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ বেশি বাংলাদেশের।
রাশিয়া
রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। পরীক্ষিত বন্ধুর মত কাজ করেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া ছাড়াও, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পাকিস্থান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় রাশিয়া। বাংলাদেশকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে এগিয়ে আসা মার্কিন সপ্তম নৌ বহরকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল রাশিয়া ও ভারত। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ছড়িয়ে দেওয়া পাকিস্থানি মাইন অপসারণ, বাংলাদেশি নৌসেনাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছিল বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া। এছাড়াও জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি, মুক্তিযুদ্ধের পর উচ্চশিক্ষা অর্জনে রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি মেধাবি শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপও দেয় রাশিয়া। অর্থাৎ রাশিয়া বাংলাদেশের দুঃসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সাথে বঙ্গবন্ধুর ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
রাশিয়া ইতোমধ্যে তার ৩১টি বন্ধুপ্রতিম ও নিরপেক্ষ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশকে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সফর করেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ প্রকল্পের সুবাদে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এযাবৎকালে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ মেগাপ্রকল্প। দুদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ভার্চুয়ালি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউরেনিয়াম জ্বালানি স্থাপনের সূচনা করেন যৌথভাবে। রাশিয়ার বরাতে বাংলাদেশ পরমাণু ক্লাবে যোগ দিতে পেরেছে। ৬০ বছর মেয়াদী ২৪০০ মেগাওয়াটের সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার শক্ত ভিত্তি হতে যাচ্ছে। এছাড়াও আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে সরকার, সেটির কাজও রাশিয়া পেতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের কৌশলী অবস্থান রাশিয়ার পক্ষেই গেছে। ফলে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। রাশিয়া বাংলাদেশে খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর অন্যতম। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাশিয়াও বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে খুবই ভালো পর্যায়ে। বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ। দেশটি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগে আগ্রহী। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ১৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে দেশটি। ইতোমধ্যে দুদেশের সরকারি পর্যায়ে এ সংক্রান্ত চুক্তিও সই হয়েছে। সৌদি আরবের এসিডব্লিউএ পাওয়ার বাংলাদেশে ১০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে একটি নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এরমধ্যে রিনিউয়েবল এনার্জি খাতে তাদের বিনিয়োগে বিশেষ আগ্রহ। এছাড়া এভিয়েশন খাতেও বিনিয়োগের আগ্রহ জানিয়েছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দিন দিন বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছর বিশ্বের ১৩৭টি দেশে বাংলাদেশের ১৩ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছর ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে ১৫% বেশি জনশক্তি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি কর্মীরাও সুনামের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করছে।
সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কোটা ২৫% থেকে বাড়িয়ে ৪০% করেছে। বর্তমানে সেখানে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি কাজে নিয়োজিত আছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১.৫ কোটি। যার সিংহভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এরইমধ্যে আরব আমিরাত জানিয়েছে বাংলাদেশ থেকে বছরে ২ হাজার কর্মী নেবে তারা।
আরব আমিরাত ও কাতারের সাথে বাণিজ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশ সফর করেন। কাতারের সাথে বাংলাদেশের ৫টি চুক্তি ও ৫টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। কাতার থেকে বাংলাদেশ এলএনজি গ্যাস আমদানি করে, যা জ্বালানি নিরাপত্তায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উদীয়মান শক্তিধর রাষ্ট্র তুরস্কের সাথেও বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। সম্প্রতি বাংলাদেশ বেশ বড় অঙ্কের সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে তুরস্ক থেকে। চুক্তির শর্ত অনুসারে তুরস্ক বাংলাদেশকে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে আগ্রহ দেখিয়েছে তুরস্ক।
আসিয়ান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে Look East Policy-কে গুরুত্ব দেন। ফলে চীন, জাপান ও ASEAN-ভুক্ত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অর্থনৈতিক কূটনীতি গ্রহণ করেন। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সফরে দুদেশের মাঝে FTA (Free Trade Agreement) করতে একটি খসড়া চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আশা করা হচ্ছে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথেও FTA স্বাক্ষরে অগ্রগতি হবে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্যই আসিয়ান বাংলাদেশকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে।
ইরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অন্যান্য
বাংলাদেশ ইইউ বাজারে ২য় শীর্ষ তৈরি পোষাক রপ্তানিকারক দেশ। স্বল্পমূল্যে তৈরি পোষাক পাচ্ছে ইইউভুক্ত দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের তৈরি পোষাকের যে সুনাম, তাতে ইউরোপে বাংলাদেশি পোষাকের ক্রেতা প্রচুর। বিশ্বখ্যাত প্রায় সব ব্র্যান্ডই বাংলাদেশ থেকে পোষাক তৈরি করে। তাছাড়া ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশও প্রচুর আমদানি করে। ফলে ইইউভুক্ত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রও বাংলাদেশের বৃহৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, অগ্রগতি ও ভূকৌশলগত গুরুত্বের জন্য বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করতে বাধ্য। সম্প্রতি ফ্রান্সের সাথে বাংলাদেশের অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মার্কিন মালিকানাধীন বোয়িং বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত বদলে প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি কোম্পানি এয়ারবাসের বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এ ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বড় ঝাঁকি দিয়েছে। মার্কিনিদের রক্তচুক্ষু উপেক্ষা করে নতজানু না হয়ে সরকারের কৌশলী অবস্থান মেরুদন্ডের দৃঢ়তার প্রকাশ। বাংলাদেশের কাছে বোয়িং বিক্রি করতে না পারা মার্কিন বিভিন্ন থিংকট্যাংক বাইডেন প্রশাসনের পরাজয় হিসেবেই দেখছে। এয়ারবাসের বিমান ছাড়াও ফ্রান্সের সাথে স্যাটেলাইট ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের চুক্তিগুলো সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গতবছর ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বাংলাদেশ সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু।
অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার সাথে সাথে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় হচ্ছে বলেই ইতোমধ্যে কানাডায় ২০৩৪ সাল এবং অস্ট্রেলিয়াতে ২০৩২ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি (Duty Free Quota Free Access) নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অস্ট্রেলিয়ায় ১১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোষাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
পরিশেষ
বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ (সূত্র: ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট)। বর্তমানে যে গতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এর আকার হবে বিশ্বে ২৮তম। এই ধারায় চললে ২০৫০ সালে বিশ্বে ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে পেছনে ফেলে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম কনজিউমার মার্কেটে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪শে নভেম্বর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সুনীল অর্থনীতিতে বাংলাদেশের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল ব্যপ্তির অর্থনৈতিক সমুদ্রসীম রয়েছে। সামুদ্রিক অঞ্চলের আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সমুদ্রসীমা জয়ের পর সমুদ্রের ২৮টি তেল, গ্যাস ব্লকের অধিকার এখন বাংলাদেশের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, এখানে ১০৩ টিসিএফ গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান মিলেছে। তাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
সুতরাং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখা পরাশক্তি এবং উদীয়মান শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। NDB (New Development Bank) এর ৬ষ্ঠ সদস্যপদপ্রাপ্তি, BRICS Summit, G20 সম্মেলনে বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ, Voice of Global South, LDCs এবং Climate Vulnerable Countries হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলাদেশের সক্ষমতারই স্বাক্ষর।
কাজেই বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ স্বনির্ভরতার সাথে নিরপেক্ষ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিদেশনীতি অনুসরণ করছে মেরুদন্ড সোজা করে। নতজানু না হয়ে নিজেদের সক্ষমতার ওপর ভর করে দেশ চলছে অন্য দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এটিই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি। সেই বাণীরই বাস্তব প্রতিফলনে বাংলাদেশ সফল হয়েছে, এটা বলাই যায়।