ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সম্প্রতি ভারত গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ সফর নিয়ে চটকদার থাম্বনেইলে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে গুজব।
সম্প্রতি ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ২৯২টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। এর প্রেক্ষিতে তৃতীয়বারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আমন্ত্রণ পেয়ে গত ৯ জুনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগেরদিন অর্থাৎ ৮ জুন ভারতের নয়াদিল্লিতে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন দিনের এই সফরে শেখ হাসিনা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ছাড়াও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফর শেষে ১০ জুন সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি।
ফ্যাক্ট চেক সংস্থা রিউমার স্ক্যানার ‘দেশ টিভি ৭১’ নামে একটি চ্যানেলের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনার এই সফর ঘিরে বিভিন্ন সময়ে আটটি ভিডিও প্রকাশ করে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবি ভিডিওগুলোর থাম্বনেইলে উপস্থাপন করা হয়েছে। মনিটাইজেশন চালু থাকা এই চ্যানেলের এসব ভিডিওতে ভারত সফরে গিয়ে শেখ হাসিনা হামলার শিকার হওয়া শীর্ষক দাবি থেকে শুরু করে তার পদত্যাগ এমনকি তাকে হত্যার গুজবও প্রচার করা হয়েছে।
‘দেশ টিভি ৭১’ নামের চ্যানেলটিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সংক্রান্ত প্রথম ভিডিও প্রকাশ করা হয় গত ৮ জুন সকাল ১০ টার কিছু পরে৷ এই ভিডিওর থাম্বনেইলে দাবি করা হয়, “বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর উপর হামলা। সকালেই দু ‘ গ্রুপের ভয়ংকর সংঘর্ষ চলছে।” প্রায় কাছাকাছি সময়েই প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান ভারতের উদ্দেশ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। অর্থাৎ, দাবিটি যখন প্রচার করা হলো তখনও প্রধানমন্ত্রী ভারতেই পৌঁছাননি। তিনি নয়াদিল্লির মাটিতে নামেন দুপুর ১২ টার কিছু সময় পূর্বে। তাই তার ওপর হামলার দাবিটি অবান্তর। একইসাথে সেদিন সকালে দেশের কোথাও ভয়ংকর কোনো সংঘর্ষের খবরও গণমাধ্যমে পায়নি রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। https://www.youtube.com/watch?v=1tzXGk5Q5-M
ভিডিওটির বিস্তারিত অংশ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এখানে একজন উপস্থাপক সংবাদ পাঠ করছেন। শুরুতে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সংবাদের শিরোনাম জানানোর পর পরবর্তীতে সংবাদগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, পুরো ভিডিওতে শেখ হাসিনার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
একই উপস্থাপককে পরবর্তী ভিডিওগুলোতেও দেখা গেছে। তাকে শুরুতে বলতে দেখা যায়, “আসসালামু আলাইকুম। সংবাদে আমি আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি, আমি ফিরোজ তোহা। শুরুতেই বিআরবি ক্যাবলস সংবাদ শিরোনাম।” পরবর্তীতে অন্য একটি কণ্ঠে শিরোনাম এবং বিস্তারিত সংবাদ পাঠ করতে দেখা যায়। ফিরোজ তোহার নামের সূত্রে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যাচাই করে দেখেছে, ভিডিওর শুরুর কণ্ঠটি এটিএন বাংলার সংবাদ পাঠক ফিরোজ তোহার। তবে তার চেহারার সাথে ভিডিওতে একই সময়ে দেখানো ব্যক্তির মিল নেই। আলোচিত ভিডিওগুলোতে কথা বলার সময় উক্ত ব্যক্তির মুখের নড়াচড়া দেখেও এটা স্পষ্ট যে, এই ব্যক্তির বক্তব্যের সময় ফিরোজ তোহার সংবাদ পাঠের অডিও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৮ জুন দুপুরে “এইমাত্র দেশ ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর উপর হামলা।” https://www.youtube.com/watch?v=Dnh4MMNTpr8 শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে প্রকাশিত আরেক ভিডিওতে শেখ হাসিনার ওপর হামলার দাবির বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। বরং তার দিল্লি পৌঁছার খবর প্রচার করা হয়েছে। তবে একই ভিডিওতে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন কোপেনহেগেনের রাস্তায় হামলার শিকার হওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু থাম্বনেইলে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর কোনো ছবি না থাকায় যে কোনো দর্শক সহজেই অনুমান করে নেবেন যে এই হামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই হয়েছে। তাছাড়া, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটিতে হামলার শিকার হননি, হয়েছেন নিজ দেশেই। এ থেকেও সহজেই অনুমেয় যে, থাম্বনেইলের বাক্যগুলো শেখ হাসিনাকেই নির্দেশ করছে৷
শেখ হাসিনার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে চ্যানেলটিতে প্রচারিত পরের ভিডিওগুলোতেও একই কায়দায় চটকদার থাম্বনেইল ব্যবহার করে ভিডিওর বিস্তারিত অংশে ভিন্ন সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। এসব ভিডিওর থাম্বনেইলের কোনোটিতে দাবি করা হয়েছে, ভারত গিয়েই বিপদে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাড়ীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে পুলিশ। কোনোটিতে দাবি করা হয়েছে, ভারতে তিনি ধাওয়ার শিকার হয়েছেন। দুইটি ভিডিওর থাম্বনেইলে তার পদত্যাগ এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা সংক্রান্ত দাবি প্রচার করা হয়েছে। একটি ভিডিওর থাম্বনেইলে প্রধানমন্ত্রী খুন হওয়ার দাবিও এসেছে। https://www.youtube.com/watch?v=NUBwPpeovQE, https://www.youtube.com/watch?v=L23TZSmztr4, https://www.youtube.com/watch?v=BQZEX4FdvBM, https://www.youtube.com/watch?v=ruP_8QZR76I, https://www.youtube.com/watch?v=ruP_8QZR76I, https://www.youtube.com/watch?v=OZgs6SKNMkc
রিউমার স্ক্যানার বলছে , প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে থাকা ব্যক্তি কোনো হামলা, পদত্যাগ, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া কিংবা মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটলে তা অবশ্যই সকল গণমাধ্যমেই খবর হতো। সার্চ ইঞ্জিন গুগলে দাবিটির বিষয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করেই এসব দাবিগুলোর সত্যতা খুব সহজেই নিশ্চিত হয়ে নেওয়া সম্ভব। আমরাও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমন কিছুই ঘটার তথ্য পাইনি। অর্থাৎ, দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। তবু এসব ভিডিওর ভিউ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
‘দেশ টিভি ৭১’ চ্যানেলটির বয়স এক বছরও হয়নি এখনও৷ গেল বছরের ২৪ জুন খোলা হয় চ্যানেলটি। এর মধ্যেই ৩ হাজার ৭০০ এর অধিক ভিডিও আপলোড করা হয়েছে এই চ্যানেলে। প্রতি সপ্তাহে গড়ে এই চ্যানেলে ভিডিও আসে ৭৩টি, মাসশেষে ৩১৮টি। চালুর পর চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার এসেছে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি। চ্যানেলটির সংবাদ সূত্র হিসেবে দেশের স্বনামধন্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল, গুগল এবং অন্যান্য অনলাইন সোর্সের কথা বলা হয়েছে। চ্যানেলটি এও দাবি করছে যে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন সঠিক সংবাদ দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু রাজনৈতিক ভুল তথ্য থাম্বনেইলে দিয়ে রাখার কারণে সঠিক সংবাদ আর সঠিক থাকছে না।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হয়েছেন এমন দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ১০টি ভিডিওর বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গহীনের বার্তা নামের একটি চ্যানেল থেকে প্রচারিত এসব ভিডিওতেও দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। https://www.youtube.com/@GohinerBarta থাম্বনেইলে জয়ের গ্রেফতারের সম্পাদিত ছবি এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার ফুটেজ সংগ্রহ করে দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। ইউটিউবে এসব ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় পৌনে সাত লাখ বার।
গবেষণা জানাচ্ছে, ৫৯ শতাংশ ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট লিংকে ক্লিক না করেই তা শেয়ার করে দেন। এক্ষেত্রে তারা আকৃষ্ট হন শিরোনাম বা থাম্বনেইলের মতো বিষয়গুলোয়। ইউটিউবে প্রতি সেকেন্ডে অসংখ্য ভিডিও আপলোড হচ্ছে। তার ভেতর থেকে কাঙ্ক্ষিত ভিডিওটি আপনার কাছে পৌঁছে দিতে ভিডিও প্রকাশকারী শিরোনাম এবং থান্বনেইলের মতো বিষয়গুলোয় বেশি মনোযোগী হচ্ছেন। ইউটিউবে ভিউয়ারদের কাছে কন্টেন্ট আকৃষ্ট করতে হরহামেশাই শিরোনাম এবং থাম্বনেইল নিয়ে কাজ করার পরামর্শ উঠে আসছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিস্তারিত ভিডিওতে যা নেই তাই শিরোনাম বা থাম্বনেইলে দিতে হবে৷ এতে করে দর্শকরা যেমন প্রতারিত হবেন তেমনি ইউটিউবের থাম্বনেইল সংক্রান্ত নীতিমালাও ভঙ্গ করা হবে। ইউটিউবের এই নীতিমালায় স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, এমন কোনো থাম্বনেইল ব্যবহার করা যাবে না যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে, যা দেখে একজন দর্শক ভাবতে পারেন, তারা কিছু একটা দেখতে যাচ্ছেন যা আসলে ভিডিওতে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই নীতিমালা ভেঙে ইউটিউবে ভুয়া তথ্যের প্রচার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এমন ২৭৫টি বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করেছে রিউমর স্ক্যানার যেগুলোতে ইউটিউবের ক্লেইমও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গতমাসেই ইউটিউবে প্রচারিত ৩৫টি বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে।