মো: সামিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধ
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে সম্ভাব্য পরোয়ানা ইস্যুতে সম্প্রতি এই ইঙ্গিত দেন তিনি। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে আমেরিকার কর্তৃত্ববাদী আচরণের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। গাজায় ইসরাইলের চালানো হত্যাযজ্ঞের বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে দেশটির পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন নীতি একান্তই দেশটির কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
গাজায় গণহত্যা ইস্যুতে ইসরায়েলি গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা জানায় আইসিসি। পরে এর বিরোধীতা করে সরব হয় ইসরায়েল এবং এর বন্ধু দেশ আমেরিকা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান আইনজীবী করিম খানকে হুঁশিয়ার করে চিঠিও দেন ১২ মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর। তবে এসবের তোয়াক্কা না করে, গত সোমবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আইসিসিতে আবেদন করেন প্রধান আইনজীবী করিম খান। তালিকায় আছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং হামাসের তিন নেতা।
এতে বেশ ক্ষুব্ধ হন নেতানিয়াহু। আইসিসির এমন আবেদন মানতে না পেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আইসিসির সমালোচনা করে নির্দ্বিধায় বলেন, গাজায় কোন গণহত্যা হয়নি। এরপর মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসি’র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাণ্টনি ব্লিঙ্কেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি। আইসিসির কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য চাপ দিচ্ছে রিপাবলিকান সিনেটররা। এই সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসে এ-সংক্রান্ত ভোট হতে পারে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিসির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ইঙ্গিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে সোচ্চার দেশগুলোর জন্য একটি গোপন হুমকি।
আরেকটি বিষয় এখানে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিষেধাজ্ঞা মার্কিন স্বার্থ হাসিলের একটি হাতিয়ার।
এ নিয়ে এক বিশ্লেষক বলেন, আপনি যদি ইসরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন তাহলে আপনি মার্কিন তোপের মুখে পড়বেন।
ছোট দেশগুলো যারা ইসরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল তারাও এখন মার্কিন রোষানলে পড়েছে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের কথা। ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিভিন্ন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয় গত মাসে। এই আন্দোলন ঠেকাতে দমন নিপীড়ন চালায় আমেরিকান সরকার। ওই আন্দোলনের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সর্ববৃহৎ সংহতি সমাবেশ হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দল ও পশ্চিমতীরের শাসকগোষ্ঠী ফাতাহ। এরপরই সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটি।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলায় নিহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি গাজায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্যসংকট। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলে চালানো হামলায় এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ৭০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৯ হাজার ৬৫২ জন। হতাহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুধু শিশুদের লক্ষ্য করে এ ধরণের হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব আর দেখেনি।
এরপরেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি মনে করেন-গাজায় কোনো ধরনের গণহত্যা চলছে না। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত, ইসরায়েলের নির্বিচার আগ্রাসনের পক্ষেই কথা বললেন।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গণহত্যার পক্ষে অবস্থানের বিষয়টি নতুন নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও চালানো পাকিস্তানের গণহত্যাকেও সমর্থন দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। এখন পর্যন্ত সেই গণহত্যার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে প্রদান করেনি দেশটি। উল্টো মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে ফেরাতে বিভিন্ন সময় মানবাধিকারের নামে বাংলাদেশের ওপর স্যাংশনের খড়গ চাপিয়ে দেয়ার নজিরও তৈরি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।