মো: সামিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধ
চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছিল বিএনপি। ‘ব্যালটে নয়, রাজপথে ফয়সালা হবে’- দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন ও পলাতক আসামি তারেক রহমানের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে সহিংসতা ও বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কামনা করে এই নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছিলো দলটি যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিন্তু এ সময় দণ্ডপ্রাপ্ত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান বিদেশে পলাতক থাকলেও তাঁর বদলি হিসেবে সরকারকে বিব্রত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
২০২২ সালের মার্চে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে আসেন পিটার ডি হাস। দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম কয়েক মাস স্বাভাবিক নিয়মে রুটিন কাজ করে গেছেন তিনি। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে তাকে দেখা যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে নাক গলাতে। ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের সঙ্গে বৈঠক করতে তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগে বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যান তিনি। ওই বাড়িতে রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে মায়ের কান্না নামের আরেকটি সংগঠনের কর্মীরা। যাদের স্বজনরা ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীর কথিত বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছিলেন। তখন তড়িঘড়ি করে পিটার হাস সেখান থেকে চলে আসেন। উল্টো নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই রাষ্ট্রদূত। এ ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয়, ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা ১৪ ডিসেম্বর একটি বৈঠক দ্রুত শেষ করেছেন নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে। আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানিয়েছি।
পিটার হাসও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা জানান। ১৫ ডিসেম্বর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে হওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অবনতি ঘটারও কোনো আশঙ্কা নেই।
এ সময় পিটার হাসের সমালোচনা করে সুশীল সমাজের বেশ কিছু বক্তব্যে দাবি করা হয়, ১৪ ডিসেম্বের বাংলাদেশের জন্য একটি শোক দিবস। এই দিন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তার দোসরগণ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কোন শ্রদ্ধা পিটার হাস জানাননি। উল্টো মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সদস্যরা তার কাছে সহায়তার জন্য মানবাধিকার বিষয়ক দাবি নিয়ে গেলে তিনি বিষয়টিকে নিজের জন্য নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে প্রচার করেন ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। যা বাংলাদেশের মূল্যবোধে আঘাত দেয়ার শামিল।
এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পুরোটাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে দৌড়ঝাঁপ করেন পিটার হাস। বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে ও গোপনে পিটার হাসের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন পিটার হাস ও তার অফিসের কূটনীতিকগণ।
গত বছরের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুরানো ভিসানীতি নতুন করে ঘোষণা দিয়ে জানায়, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় হবেন যারা তারাই পড়বেন ভিসানীতির আওতায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই ঘোষণার পর আগ বাড়িয়ে পিটার হাস মন্তব্য করেন, গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরাও পড়তে পারেন ভিসানীতির আওতায়। পরে অবশ্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে হাসের দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে আসে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির আলোচিত দিন ২৮ অক্টোবর। ওইদিন ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ সকাল দিয়ে শুরু হলেও বেলা গড়িয়ে শেষ হয় চরম সহিংসতার মধ্যদিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাপক মারধর। এক পুলিশ সদস্য হত্যা। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ নজিরবিহীন তাণ্ডব দেখে বিশ্ব। এই ঘটনায় কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যান পিটার হাস। এ সময় শ্রীলঙ্কা হয়ে নিজ দেশ সফরের পর আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি তাকে। এই সমাবেশের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন তিনি। শুধু তাই নয়, এই সহিংস কার্যক্রমের পূর্বে ২৫ অক্টোবর পিটার ডি হাস ও তার অফিসের বেশ কয়েকজন কূটনীতিক বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ডিনারে বসেন বলেও জানা যায়। এ সময় কার্যত পিটার হাস নিরব থাকলেও তার হয়ে বক্তব্য প্রচার করে গিয়েছেন মার্কিন লবিস্টদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক জানান, ২০২৩ সাল জুড়ে সরকারি কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সিনিয়র পর্যায়ের সাংবাদিক সহ অনেকের সঙ্গেই বৈঠক করেছিলেন পিটার ডি হাস। এ সময় তিনি প্রচ্ছন্নভাবে যেই হুমকি প্রদান করেন, তা হলো এই ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে। সরাসরি এ কথা না বললেও একাধিক ডিনারে পিটার হাস মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বরাত দিয়ে জানান, যে কেউ ভিসা নীতির আওতায় পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে রাখার জন্য কোন ব্যবস্থা তার হাতে নেই। সরাসরি না বললেও পিটার হাস যাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন বলে সূত্রগুলো জানায়। সুতরাং এটি যে কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারের বাহিরে গিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিলো তা বেশ স্পষ্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই গণতন্ত্র, শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকারের কথা বলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বুলি আওড়াচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকেও বেশি সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন পিটার ডি হাস। বিএনপি কিংবা তার সমমনাদের মতো নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা মুখে না বললেও, নিজেদের পছন্দমতো সুশীলদের দিয়ে একটি সরকার গঠনের বিষয়ে কাজের একাধিক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস সফল হয়েছিলেন এই কাজটি করতে যার ফল হিসেবে সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলো।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, তারেকের অবর্তমানে বিএনপিকে আগলে রেখেছেন পিটার হাস। আর এ লক্ষ্যে সিজিএস- এর মতো মার্কিন সুবিধভোগী কিছু এনজিও ও সুশীল দিয়ে চেষ্টাও করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত নিজ মিশনে ব্যর্থ হয়ে দায়িত্বের সময় পার হবার আগেই ফেরত যেতে হচ্ছে পিটার ডি হাসকে। বরং সম্প্রতি মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এর সফরে হওয়া আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হাত বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান হিসেবে মনে করছনে কূটনৈতিক বিশ্লেষকগণ।