আবুবকর সিদ্দিক , কয়রা উপজেলা
খুলনার কয়রা উপজেলায় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ৪৯টি ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বেশি দরে জমি ক্রয়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নিচু করে ভরাট, বেস ঢালাই না দেয়া, মরিচা যুক্ত রড ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, অনিয়মের অভিযোগে ওই প্রকল্পের কাজ কয়েকবার বন্ধ হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে ২৯ টি ঘর ভেঙে নতুন করে তৈরির নির্দেশনা দেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। পুনরায় ঘর নির্মাণ শুরু হলেও যথাযথ নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পূর্বের মরিচা ধরা রড, মেয়াদ উত্তীর্ণ সিমেন্ট, লোনা পানি মিশ্রিত বালি ও নিম্নমানের ইট ব্যবহার করে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। অনিয়মে তৈরীকৃত ২৯টি ঘর ভেঙ্গে নতুন তৈরীর কথা থাকলে তা যথাযথ পালন করা হচ্ছে না। আগের নির্মাণকৃত ঘরের ভিত ভেঙে নতুন করে বেস ঢালাই দিয়ে তৈরির কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কয়েকটি ঘর নামমাত্র ভেঙে পুরাতন ভিত এর উপরেই ইটের গাঁথুনি দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখনও ১৩টি ঘর ভাঙা হয়নি। ইট, বালু ও খোয়ার মান খারাপ হওয়ায় ঘরের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঘরের ভিত তিন ফুট উচু করার কথা থাকলেও মাত্র দেড় ফুট বালুর উপরে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। বন্যার পানির লেবেলের নীচে ঘরের মেঝে নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
আরও জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির অন্য সদস্যদের অবহিত না করে সভাপতি নিজের পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। একই সাথে প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীও তিনি নিজের ইচ্ছামত ক্রয় করছেন। কামরুল ইসলাম নামে যে ঠিকাদারকে দিয়ে ঘর নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে এর আগে বীর নিবাস প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ করেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করা হয়।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, কপোতাক্ষ নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে প্রকল্পের স্থান ভরাট করা হয়। অবৈধ বালু ব্যবহারে বরাদ্দের অর্ধেক লোপাট হয়েছে। নোনা পানি ঢুকায় ফসলসহ কৃষি জমির ক্ষতি হয়। স্থানীয়দের বাঁধার মুখে বালু ভরাট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। একপর্যায়ে ফের কপোতাক্ষের বালু দিয়েই ভরাট করা হয়। অন্যদিকে ঘরগুলো নীচু জায়গায় স্থাপন করায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
আরো জানা গেছে, ২০২৩ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোমিনুর রহমান আশ্রয় প্রকল্পের জমিটি রেজিস্ট্রেশন করেন। জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রকৃত মূল্যের অনেক বেশি দেখিয়ে দলিল করার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া কপোতাক্ষ নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ভরাট করতে চাইলে স্থানীয়দের বাঁধার মুখে পড়েন। এ বিষয়ে ওই সময় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। একপর্যায়ে তিনি বদলী হওয়ার পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মোঃ কামাল হোসেন যোগদান করে ফের ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তখন তলে ঢালাই না দিয়ে এবং নিম্নমানের ইট দিয়ে ঘর তৈরি করার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। জাতীয় নির্বাচনের পরে তিনি বদলী হওয়ায় কয়রা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ তারিক উজ-জামান ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। পদাধিকার বলে তিনি প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ফের কাজ শুরু করেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের ঘর ভেঙে তৈরি করার নির্দেশন যথাযথ পালন না করেই পূর্বের মরিচা ধরা রড দিয়ে কাজ করেন তিনি। এরপরে সম্প্রতি নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রুলী বিশ্বাস যোগদান করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রকল্পের সদস্য সচিব পিআইও মামুনার রশিদ, সদস্য- উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ দারুল হুদা, কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস, এম, বাহারুল ইসলামদের সাথে। তারা তিন জনই এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে মত প্রকাশ করেন। আরও অভিযোগ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৪৯টি ঘর নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ও সদস্যদের অজান্তে নিজের খেয়াল খুশি মত বিল ভাউচার তৈরী করছেন সভাপতি।
এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা সুজনের সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের দেয়া ৪৯টি ঘর নির্মানের জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে ঘর গুলো হওয়ার কথা। কিন্তু ঘর নির্মাণের বিষয়ে সাধারণ সদস্যরা কিছুই না জানার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, পূর্বের মরিচা ধরা রড, মেয়াদ উত্তীর্ণ সিমেন্ট, লোনা পানি মিশ্রিত বালি ও নিম্নমানের ইট ব্যবহার করে নামমাত্র কয়েকটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পূর্বে ব্যাপক অনিয়মে তৈরীকৃত ২৯টি ঘর ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করার কথা থাকলে তা এখনও বহাল আছে। এছাড়া মাটি ছাড়া ৩ ফুট বালু দিয়ে ঘরের ভিত উচু করার কথা থাকলেও মাত্র দেড় ফুট বালির উপরে ঘর তৈরি করা হয়েছে যা হুমকির মুখে।
জানতে চাইলে নির্মাণ কাজের ঠিকাদার কামরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি ঘর নির্মাণ কাজের জন্য মালামাল বাদে আমাকে ৩৯ হাজার টাকায় চুক্তি করে দেওয়া হয়েছে। ঘরের নির্মাণ সামগ্রী প্রকল্পের সভাপতি ইউএনও স্যার কিনে দিচ্ছেন এবং নিজেই কাজের তদারকি করছেন। তাছাড়া ঘর নির্মাণে প্রকল্পের নক্সা ও প্রাক্কলন অনুসরণ করা হচ্ছে। ফলে কাজের মান খারাপ হওয়ায় কিছু নেই।
এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি এবিএম তারিক উজ-জামান বলেন, আমি প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণের আগে কিছু অনিয়ম হয়েছিল। ঘর নির্মাণে তলে(ভিট) ঢালাই না দেওয়ায় ২৯টি ঘরের ভিট ও ওয়াল ভেঙে নতুন করে তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়। ১৬ টি ঘর ভেঙে ফের তৈরি করা হয়েছে। বাকী ১৩টি ঘরও ভেঙে নক্সা অনুযায়ি তৈরি করা হবে।
নবগত কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
প্রসঙ্গত, আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের গৃহ প্রদানের জন্য উপজেলা সদরের দক্ষিণ মদিনাবাদ গ্রামে সাড়ে ৪ একর জমি কিনে সেখানে ৪৯টি সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা বরাদ্দে দুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম থাকবে।
সম্পাদকীয় ও বাণিজিক কার্যালয়: ব্লক: ই, সেক্টর: ১৫, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০
নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৬১৯৮৭৭১৫৭, ইমেইল: news@hotnews24.news
সম্পাদক ইমেইল: editor@hotnews24.news, বিশেষ প্রয়োজনে: hotnewslive24@gmail.com
কপিরাইট ©2006-2024 hotnews24.news