বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সেখানে পুরোদমে ছাত্র রাজনীতি চালাচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াত ইসলামের ছাত্র সংগঠন শিবির। আর এটি স্বীকার করে নিয়েছেন জামাত শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারাও। সম্প্রতি শিবিরের একটি সূত্র থেকে সংগঠনটির বুয়েট শাখার কার্যক্রম পরিচালনা কমিটির তালিকা প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে, যেখানে বুয়েট শাখায় সভাপতি, সম্পাদক ও বায়তুল মাল সহ ছাত্র আন্দোলন এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকা একাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে আসে যারা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে শিবিরের কর্মীদের সঙ্গে রাষ্ট্র বিরোধি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আটক হন।
বুয়েটকে ঘিরে শিবিরের কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে তাদের নিয়েও গুজব রটানো শুরু হয়। সেই সঙ্গে তাদের র্যাগিং এবং হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি প্রদানের পাশাপাশি সর্বশেষ ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে জীবনের হুমকিও প্রদান করা হয়। অবশ্য বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মতে, শিবিরের এমন কার্যক্রম নতুন কিছু নয়। বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে কোন শিক্ষার্থীকে দমাতে না পারলে তাকে নিয়ে গুজব ও হত্যার হুমকি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে হামলাও চালানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত জামায়াত ইসলাম ও তার ছাত্র সংগঠন। এটি পরে স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে শিবির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। যা পরবর্তীতে উগ্রবাদীবিরোধী ও প্রগতিশীল ছাত্রদের নির্মমভাবে নির্মূল করার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত করে। কয়েক মাস আগে বুয়েট ক্যাম্পাসে শিবিরের সক্রিয় উপস্থিতি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছেন শিবিরের সাবেক সভাপতি প্রভাবশালী নেতা ড.মু.শফিকুল ইসলাম যিনি বর্তমানে জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণ শাখার সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য।
গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামায়াতের ওই নেতা বলেন, বুয়েট হলো বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীদের জায়গা, তাই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পাসে কাজ করছি। বুয়েটের ছাত্র ছাড়া শিবিরের মতো সংগঠন কীভাবে চালানো যায়?
জানা গেছে, বুয়েটে শিবিরের ছাত্র ইউনিটের নেতৃত্বে রয়েছেন আলী আম্মার মোয়াজ (সভাপতি), মো. মঈনুদ্দিন (সম্পাদক), ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক পদে আছেন মাহমুদ আকন, সহ-প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার হাসান, প্রকাশনা সম্পাদক ফয়সাল হাবিব, সাহিত্য সম্পাদক আল ফারাবী, বায়তুল মাল সম্পাদক দায়িত্বে আছেন আফিফ আনোয়ার এবং শাহ মোস্তাফা রেজা আছেন কোচিং পরিচালক পদে। পুরো বুয়েট ক্যাম্পাস দুটি থানায় পড়ায় উভয় ইউনিটের কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক রয়েছে। এই ইউনিটে রয়েছেন ফাহাদুল ইসলাম (থানা শাখার সভাপতি) এমএ মোসাব্বির অন্তর (থানা শাখার সম্পাদক) এবং এমাদ আল মাহাদী (থানা শাখার সভাপতি)।
এদিকে বুয়েট ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যকলাপের উত্থানের খবর এখন প্রকাশ্যে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামের ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের বুয়েট ইউনিটের তদারকি করা কিছু শিক্ষার্থীকে একটি গোপন মিশনে নামানো হয়েছে। এই শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ সুনামগঞ্জে টাঙ্গুয়ার হাওরে গ্রেফতার হয়েছিলেন শিবিরের অন্যান্য সহ সংগঠকদের সঙ্গে। শিবির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই নেটওয়ার্কে বুয়েটের ১৬ তম ব্যাচের একজন সাবেক শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে ১১ জন সদস্য রয়েছেন। আর বাকিরা কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হয়ে ক্লাস করছে এবং ছাত্রাবাসে অবস্থান করছেন।
ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও গত জুন মাসে একটি প্রত্যন্ত হাওর এলাকায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুয়েটের ২৪ জন শিক্ষার্থী। তৎকালীন সময়ে সুনামগঞ্জ জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল হাসান আবেদ জানান, গ্রেপ্তার মধ্যে কয়েকজন শিবিরকর্মী রয়েছে।
গত বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে গ্রেপ্তার হওয়াদের একজন শিবিরের বুয়েট শাখার সম্পাদক ও ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. মঈনুদ্দিন বুয়েটের সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। শিবিরের প্রকাশনা সম্পাদক ও ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফয়সাল হাবিবও আটক হন টাঙ্গুয়ার হাওরে। টাঙ্গুয়ার হাওরে আটক হওয়াদের তালিকায় আরও আছেন বুয়েট কেন্দ্রিক একটি থানা শাখার সভাপতি ও ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাহাদুল ইসলাম এবং ১৮তম ব্যাচের এমএমই বিভাগের শির্ক্ষাথী ও বুয়েট শিবিরের বায়তুল মাল পদে (অর্থ সম্পাদক) থাকা আফিফ আনোয়ার।
জানা গেছে, বুয়েটে শিবিরের একটি নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাশকতামূলক কার্যকলাপে প্ররোচিত করা, ধর্মের মিথ্যা ব্যাখ্যা ছড়ানো সহ আরও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেইসঙ্গে উগ্রবাদী মতামতের বিরুদ্ধে কথা বলা ছাত্রদের র্যাগিং করছে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে। বুয়েট শিবিরের কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পদাক সহ একজন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদকও রয়েছেন যারা ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রীয় শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সামগ্রিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধায়ন করেন। তবে এই তালিকার বাহিরে থেকেও শিবির কর্মী হিসেবে পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন আরও কিছু বুয়েট শিক্ষার্থী, যাদের মূললক্ষ্য বুয়েট শিক্ষার্থীদের শিবিরের কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট করা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে উগ্রবাদী চেতনার বিকাশ ঘটানো।
এদিকে বুয়েটে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের অন্যতম মূলহোতা ২০ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদ আকন। ছাত্ররাজনীতিবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা থেকে দূরে রাখতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার রয়েছেন। তাঁর ব্যাচের ৫ শিক্ষার্থী এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে একজন ফাহাদুল ইসলাম। যিনি বিলুপ্ত হওয়া বুয়েটের সাংবাদিক সমিতির কমিটির কোষাধ্যক্ষ পদে ছিলেন। সুনামগঞ্জে হাওরে গিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী বৈঠকে ধরা পড়া ছয় শিক্ষার্থী এই সাংবাদিক সমিতির কমিটিতে ছিল। সেইসঙ্গে নামে সাংবাদিক সমিতি হলেও সেখানকার কেউ মূলধারার গণমাধ্যমে কাজ করত না।
বুয়েট ক্যাম্পাসে অচলাবস্থার সময় হিযবুত বাংলাদেশে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে জামায়াত সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজগুলো থেকে সক্রিয়ভাবে বুয়েটের সেই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প ছড়াচ্ছে যারা যুদ্ধাপরাধীদের দায়মুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আর এবারও কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর নিয়োগ করা যুক্তরাজ্যের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাইকেল পোলাকের অংশগ্রহণে উদ্বোধন হওয়া একটি ফেসবুক পেজ থেকে সেই সকল ব্যক্তিদের টার্গেট করে মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন। সেখানে ‘যুদ্ধাপরাধীদের মহান হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা’ নিয়ে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-৭১।
রগ কাটা ও ছুরি হামলা চালিয়ে এক সময় ত্রাস সৃষ্টি করেছে ছাত্র শিবির। আর এ হামলার শিকার হয়েছে ছাত্রলীগের শত শত কর্মী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চরমপন্থী ও শিবির সংগঠনের পেজগুলো থেকে গোপনে হত্যার হুমকি দেওয়ায় সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থীদের একটি দল প্রধানমন্ত্রী কাছে নিরাপত্তর জন্য আবেদন করেছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া পছন্দ করেনি তাদের পরিচালিক প্রোপাগান্ডা সেল হিসেবে পরিচিত বাঁশেরকেল্লা। বুয়েটে অস্থিরতার মধ্যে এই বাঁশেরকেল্লার অফিসিয়াল পেজ থেকে শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষা বর্জন রাখার আহ্বান জানানো হয়নি। সেই সঙ্গে শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে তাদের নাম পরিচয় খুঁজে বের করে প্রকাশের আহ্বান করা হয়। যেমনটি ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার গোষ্ঠীকে টার্গেট করে এই মৌলবাদীরা। ২০১৩ সালে এভাবেই আরিফ রায়হান দীপের হলের রুম নম্বর ও অন্যান্য তথ্য প্রকাশ করা হয় এবং তাকে হলে নিজ রুমে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান আরিফ রায়হান দীপ। একই ভাবে তন্ময় আহমেদের হলে ঠিকানা ও গ্রামের ঠিকানা বিভিন্ন সময় শেয়ার করা হয় যার মাধ্যমে তার গতিবিধি লক্ষ্য করে গাইবান্ধায় রাতের অন্ধকারে গুরুতরভাবে তাকে জখম করে মৃতভেবে রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য দেশব্যাপী গুপ্ত হত্যা, বাস ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, বোমা হামলা ও সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় জামাত। গত বছরও দলটি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একের পর এক ঘৃণামূলক প্রচারণা চালায় । নির্বাচনের আগে বিএনপির অবরোধের শেষ পর্যায়ে সহিংস হামলা চালালেও তাতে সমর্থন দেয় জামায়াত।