‘সরকার কোটা বহাল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে’- সম্প্রতি এমন রাজনৈতিক বক্তব্য বিএনপি ও সমমনা দলগুলো থেকে করা হলেও বাস্তবতায় দেখা যায় কোটার পক্ষে দেয়া আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আন্দোলনকারী কোন গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই আইনী লড়াই চলছে না বরং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে লড়ছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। অর্থাৎ বলা যায় কোটা বাতিল করে সরকারের জারি করা ২০১৮ সালে প্রজ্ঞাপনের পক্ষে সরকার আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর (নবম-ত্রয়োদশ গ্রেড) সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। তারপর থেকে আগের মতো বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। এটি সংস্কারের বা পুনর্বহালের কোন ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সেই ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র নিয়ে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। যার ফলে সরকারি চাকরিতে আগের ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল হবে বলে জানানো হয়। এরপর থেকেই রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোটা বিরোধি আন্দোলন পুনরায় শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও এ বিষয়ে সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করা কোন পক্ষই আদালতের কাছে এ বিষয়ে কোন আপিল জমায় দেয়নি।
বেসরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের ফলে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়েছিল, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। যেখানে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি ৫ ও প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়। এই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সে রুল যথাযথ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে ৪ জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দেয় চেম্বার জজ আদালত। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ চেম্বার আদালত এ বিষয়ে শুনানি মুলতবি করেন। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির জন্য বুধবার (১০ জুলাই) দিন নির্ধারণ করা হয়। যেখানে রাষ্ট্রপক্ষে অর্থাৎ সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন। অর্থাৎ কোটা বাতিল করে দেয়া প্রজ্ঞাপণের পক্ষে লড়ছে সরকার।
কিন্তু এমন অবস্থায় জনজীবন নাকাল করে রাস্তা বন্ধ করে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমালোচনা করা হয়েছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। স্বাধীন বিচার বিভাগের রায়ের অপেক্ষমান একটি বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে মূলত সরকারবে বিব্রত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। আদালতে কোটা বাতিল করে দেয়া প্রজ্ঞাপণের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ হতে লড়াই চালিয়ে গেলেও সরকার কোটা পুনর্বহাল করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর ‘ভরসা নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন কোটা বিরোধি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া অনেকেই যা আদালত অবমাননার শামিল।
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্যে কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরার অনুরোধও করেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি বিচারাধীন বিষয় এবং আমি সরকারের পক্ষ থেকে মামলাটি করেছি। আমি এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমরা রায়টা পেয়ে নিই, অবশ্যই দেখব।…আমরা আইনগত বিষয়টি দেখছিলাম। এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এখানে আদালত কতটুকু হস্তক্ষেপ করতে পারে, তা আদালতের সামনে তুলে ধরেছি।’
কোটার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আদালতের একটা আদেশ। আদালত আদেশ দিয়েছেন, সে আদেশের বিরুদ্ধে সরকারও আপিল বিভাগে গিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে…যে আন্দোলন, আমি মনে করি এটি উনাদের না করাই উচিত হবে।…কারণ, আদালতে যেটি বিচারাধীন বিষয়, সে বিষয়টা রাজপথে না এনে, আদালতে আছে, বিচার হচ্ছে, বিচার হবে। সে ক্ষেত্রে উনাদের একটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ করব আমি।…আমি ঠিক জানি না উনারা কেন (আন্দোলন) করছেন? আমরা মনে হয়, আন্দোলন না করলেই ভালো হতো।’
কোটার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যখন আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। সেই সঙ্গে বিচারাধিন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তারা। কেননা আদালত অবমাননাকর কিছু বললে নিশ্চিতভাবেই ঐ ব্যক্তিকে দায়ী করে তার বিচার করার স্বাধীনতা রয়েছে বিচার বিভাগের।
কোন দেশে কোটা ব্যবস্থা কেমন?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের মাধ্যমে তাদের জনসংখ্যার মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। দেখা যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরি বা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কোটা বিন্যাস।
ভারত
আমাদের ঠিক পাশের দেশ ভারতেই সরকারি চাকরিতে আছে কোটা ব্যবস্থার সুবিধা। ভারতে কোটা আছে মোট ৪ ধরনের। যেমন- ১. আদিবাসী বা তফসিলি কোটা, ২. অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা, ৩. জাতভিত্তিক কোটা, ৪. বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কোটা। ভারতের মোট ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোটার সঙ্গে সঙ্গে একটি সুষ্ঠু কোটা বণ্টন ব্যবস্থাও আছে। একটি পরিবারে শুধু একজনই এই কোটা ব্যবহার করতে পারবে ও উচ্চশিক্ষায় কোটার ব্যবহার করা হলে চাকরিতে সেই ব্যক্তি আর কোটা ব্যবহার করতে পারবে না।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে কোটা পদ্ধতি চালু আছে বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। দেশটিতে কোটা পদ্ধতির মূল কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব অঞ্চলের মানুষ যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। পাকিস্তানে কেবলমাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে বিভিন্ন চাকুরীতে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রায় ৯৩ শতাংশই কোটা ভিত্তিক নিয়োগ হয়।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৫০ দশমিক ১ শতাংশ মালয়। মালয়েশিয়ান উচ্চশিক্ষায় জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী। চাকরি, স্বল্পমূল্যে বাসস্থানসহ সব ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ভোগ করে মালয় আর ৪০ শতাংশ ভোগ করে অন্য সব জনগোষ্ঠী।
কানাডা
উন্নত রাষ্ট্রের একটি রোলমডেল কানাডাতেও রয়েছে কোটা ব্যবস্থা। সেখানে মূল চারটি শ্রেণির জন্য কোটা প্রযোজ্য। যথা- নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু। কিন্তু এই ৪ শ্রেণির কোন কোটার জন্য কত শতাংশ সেটা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা নেই। তবে এখানে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরির জন্যও কোটা বিধি রয়েছে।
নেপাল
নেপালের সরকারি চাকরিতে কোটা দুই ভাগে করা আছে। একটি সাধারণ কোটা (৫৫ শতাংশ) এবং অন্যটি সংরক্ষিত কোটা (৪৫ শতাংশ)। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মাদেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ও প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে আলাদা আলাদা ভাগ করা রয়েছে।
জাপান
অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও আছে কোটা ব্যবস্থা। বুরাকুমিন ও কোরীয় সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা বেসরকারি কোনো পণ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা ৫ শতাধিক হলে বুরাকুমিন এনং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই দেখা যায় কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন রয়েছে। তবে বাংলাদেশে কোটা বাতিলের বদলে কোটা সংস্কারের প্রস্তবনা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কোটা বাতিল হলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো আরও পিছিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে নারী কোটা বাতিল করলে বিশ্বে নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সেই ইনডেক্সেও হঠাৎ করে পতন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।