সাভার প্রতিনিধি
ঢাকার সাভারে এক বিএনপি নেতার ছেলেকে পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক মনোনীত করার গুঞ্জন উঠেছে। এতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝেও চলছে সমালোচনা। দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মীরা পদবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ত্যাগীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বিএনপি নেতার ছেলে রাজীম ভূঁইয়া মিশুকে আহ্বায়ক করার গুঞ্জনে ঢাকা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জি এস মিজানুর রহমানের কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয় এ নিয়ে গণমাধ্যমেও মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেকে।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী যুবলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে ঢাকা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য মিজানুর রহমানকে (জিএস মিজান) আহ্বায়ক এবং মাসুদ আহমেদ, হাজী এইচএম সেলিম, ইরফান উদ্দিনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ঢাকা জেলা যুবলীগের ৪১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
এতে বলা হয়- আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা জেলা যুবলীগের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের যৌথ স্বাক্ষরে আগামী ৯০ দিনের জন্য মিজানুর রহমানকে (জিএস মিজান) আহ্বায়ক এবং মাসুদ আহমেদ, হাজী এইচএম সেলিম, ইরফান উদ্দিনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ঢাকা জেলা যুবলীগের ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঢাকা জেলা যুবলীগের ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটিকে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তাদের অধীন সব শাখার সম্মেলন সম্পন্ন করে ঢাকা জেলা যুবলীগের সম্মেলন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা জেলা কমিটি গঠনের পর চলতি বছরের ৬ জুন ঢাকা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জি এস মিজানুর রহমান এবং যুগ্ম-আহবায়ক মাসুদ আহমেদ, হাজী এইচএম সেলিম, ইরফান উদ্দিন এর যৌথ স্বাক্ষরে এক বিবৃতিতে সাভার পৌর শাখার নেতাকর্মীদের জীবন বৃত্তান্ত জমা দেওয়ার আহবান জানানো হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ০৯ জুন রবিবার থেকে ১১ জুন মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়, প্লট নং ৪০৩, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা, শাখায় জীবন বৃত্তান্ত জমা নেওয়া হবে। জীবন বৃত্তান্তের সঙ্গে জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি ও সর্বশেষ শিক্ষা সনদের ফটোকপি এবং রঙ্গিন তিন কপি ছবি দিতে বলা হয়।
ঢাকা জেলা যুবলীগ সূত্র জানায়, সাভার পৌর শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠনের জন্য জীবন বৃত্তান্ত আহ্বান করার পর এ পর্যন্ত ৬১ জন নেতা কর্মীর জীবন বৃত্তান্ত জমা পড়েছে। এতে সাভার পৌর বিএনপি নেতা গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়ার ছেলে রাজিম ভুঁইয়া মিশু আহ্বায়ক প্রার্থী হয়।
যুবলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন,
বিএনপি নেতা গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়ার বাড়ি বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালীর সুধারাম থানা এলাকায় ১১১ জনকে সরাসরি হত্যার দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় নেতা আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ফয়েজ উল্লাহ ভুঁইয়ার ছেলে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়া।
রাজিম ভুঁইয়া মিশুর বাবা সেলিম ভুইয়া রাজাকার মনসুরের সহযোগিতায় নোয়াখালীর লক্ষীপুর ছেড়ে সাভারে এসে স্থায়ী হয়ে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। সাভারের মনসুর মার্কেটের মালিক দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার নামে জিয়া পরিষদ গঠন করা হয়। সাভার পৌরসভা শাখা জিয়া পরিষদের শীর্ষ নেতার পদ দীর্ঘদিন যাবত অলংকৃত করে রাখেন গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়া। দীর্ঘ দুই যুগের পর ২০১৭ সালের ৩ জুন সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের দিলখুশাবাগ এলাকার হোল্ডিং-৫৪ নাম্বার ঠিকানায় তিনি সাভারের ভোটার হন। বর্তমানে গণহত্যার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার মনসুর সিঙ্গাপুরে পলাতক থাকায় মনসুরের জামাতা সাভার পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুর রহমানের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারের স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জানান, সাভারের কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার সুপারিশে বিএনপি নেতা গোলাম মোহাম্মদ ওরফে সেলিম ভুঁইয়ার ছেলে হওয়া সত্ত্বেও রাজিম ভূঁইয়া মিশু সাভার পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক হতে আর অল্প কিছু সময় বাকি। পবিত্র ঈদুল আযহা শেষ হয়েছে এখন তাঁকে আহ্বায়ক করে কমিটি ঘোষণা করা হবে।
তিনি আরো বলেন, রাজিম ভূঁইয়া মিশু একসময় নিজেও ছাত্রদলের প্রোগ্রাম করতো। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ট্রাম শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় ট্রামে যখন আবার ক্ষমতায় আসলো ঠিক তখনই সে ভোল্ট পাল্টে ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে শুরু করে। রাজিম ভুঁইয়া মিশু নিজেকে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো স্বেচ্ছাসেবক লীগ আবার কখনও হকার্স লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ান। এবার যুবলীগের রাজনীতির পদ বাগিয়ে নেওয়ার প্রবল চেষ্টায় আছেন তিনি।
এই নেতা বলেন, রাজীম ভূঁইয়া মিশু প্রথমে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার পিয়ন ছিল। সেই রানা আলোচিত ভবন ধ্বসের মামলায় কারাগারে গেলে কিছুদিন পরে আমাদের সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকের সঙ্গে ফেস্টুন দিয়ে পরিচয় জাহির করলো। এরপর কিছুদিন সদ্য প্রয়াত যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু আহমেদ নাসিম পাভেলের সঙ্গে ফেস্টুন দিয়ে নিজেকে জাহির করলো। বর্তমানে সাভার উপজেলার চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম রাজীব এবং ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম সমরকে নিয়ে ফেস্টুন ছাপিয়ে সাড়া সাভার ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের আস্থা অর্জনে রাজিবের ঘনিষ্ঠ ও রাজ গ্রুপের এমডি জাকির হোসেন ওরফে মামা জাকিরের ফেসবুক আইডিতে ট্যাগ দিয়ে কিছু সময় পরপর বিভিন্ন ছবি পোস্ট করার প্রতিযোগিতা চালিয়ে আসছে রাজীম ভূঁইয়া মিশু।
পৌর যুবলীগের আহবায়ক প্রার্থী রাজীম ভূঁইয়া মিশুর এক নিকট আত্মীয়(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, মিশু একটা পল্টিবাজ। সে নগদে নারায়নে বিশ্বাসী। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মে জড়িত মিশু। বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে শারীরিক সম্পর্কের পর পেটে বাচ্চা আসলে গর্ভপাত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাত চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, নারী দিয়ে দেহ ব্যবসা, ফিটিং বাজি, ফ্লাট দখল তার নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। নিজেকে সে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে এসব অপকর্ম করে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। মিশু নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় আত্মীয়-স্বজনদেরও নির্যাতন করেছে বলেও অভিযোগ করেন তাঁর এই নিকটাত্মীয়। অপকর্মের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও হয়েছে। আমরা ফ্যামিলিগত ভাবেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বিএনপি নেতার ছেলে আজ আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক প্রার্থী হয়েছে এটা খুবই কষ্টের। কারণ এর সাপোর্ট দিচ্ছেন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা।
এ বিষয়ে জানতে সাভার পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক প্রার্থী রাজীম ভূঁইয়া মিশু বলেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা যুবলীগের আহবায়ক জিএস মিজানুর রহমান মিজান বলেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের নির্দেশে আমরা নেতাকর্মীদের জীবন বৃত্তান্ত আহ্বান করেছি। এপর্যন্ত প্রায় ৬০ টি সিভি আমরা পেয়েছি। তদন্ত করে যাকে যোগ্য মনে করা হবে তাকেই আমরা পদ দেওয়ার সুপারিশ করবো।