বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের ক্যাশিয়ার খ্যাত আব্দুল আউয়াল মিন্টু সাংবাদিকদের বলেছেন বর্তমান সরকারের আমলে চুরি-ডাকাতি-দুর্নীতিতে জড়িতদের নামের তালিকা করছে তার দল। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আসুন একটু হেসে নিই ভূতের মুখে রাম নাম শুনে। কেন? চলুন, কয়েক বছর আগের কিছু চাঞ্চল্যকর খবরে ফিরে যাই।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) নামের একটি সাংবাদিক সংগঠন সারাবিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কিছু নথিপত্র এক্সপোজ করে তিন ধাপে। ২০১৬ সালে পানামা পেপার্স, ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপার্স এবং ২০২১ সালে প্যান্ডোরা পেপার্স নামে প্রকাশিত এসব নথিপত্র বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, তারকাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। যারা ট্যাক্স হেভেন নামে পরিচিত বিভিন্ন দেশে ভুয়া কোম্পানি খুলে তার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন অবৈধ ডলার সাদা করেছেন, বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন, গোপন চুক্তির মাধ্যমে অনৈতিক কাজ করেছেন। এসব আর্থিক অপরাধের খতিয়ান জনসম্মুখে চলে আসায় বিশ্বের প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়ে যায়।
প্যারাডাইস ও প্যান্ডোরা পেপার্সে মিলেছে বাংলাদেশি নাগরিকদের নাম। যারা দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সম্পত্তির পাহাড় গড়ে, বিদেশে পাচার করেছেন। তবে দুবারই তালিকায় একটি পরিবার ছিল কমন। সেই পরিবারটি হলো আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও তার পরিবার এবং তাদের মালিকানাধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম। নথিপত্রে উঠে আসে, কীভাবে, কোন দেশ থেকে, কার মাধ্যমে অর্থপাচার করা হয়েছে- এসব তথ্য। আইসিআইজে জানায়, তাদের কাছে থাকা ১ কোটি ১৯ লাখ আর্থিক লেনদেনের নথিতে ১৪টি অফশোর সার্ভিস কোম্পানির ২.৯৪ টেরাবাইট গোপন তথ্য রয়েছে। যাতে রয়েছে আব্দুল আউয়াল মিন্টু পরিবারের সদস্যদের নাম।
প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় মিন্টু, তার স্ত্রীসহ ৩ ছেলের নাম এসেছিল। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে অফশোর কোম্পানি খুলে মিন্টু পরিবার হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। এতে তার সঙ্গী ছিলেন নেপালের বিলিওনিয়ার বিনোদ চৌধুরী, যিনি দেশটির হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে কংগ্রেসের মনোনীত সদস্য। প্যান্ডোরা পেপার্সের নথির বরাতে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালের (এএনআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত বিনোদ চৌধুরীর কোম্পানি সিনোভেশনে জড়িতদের একজন হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আব্দুল আউয়াল মিন্টু, যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ঢাকায় অর্থ পাচার ও ঋণ জালিয়াতির তদন্ত করে দুদক। প্যান্ডোরা পেপার্সে নাম আসায় সেসময় দেশের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো মিন্টুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তার সহকারী হুমায়ুন কবির জানান, স্যার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না, ফোনও ধরবেন না স্ট্রিক্টলি জানিয়ে দিয়েছেন। পাক্কা দুর্নীতিবাজ না হলে গণমাধ্যমকে কেন এড়িয়ে গেলেন মিন্টু?
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং আইসিআইজের ওয়েবসাইটে বর্ণিত দেশভিত্তিক তালিকা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশির ক্ষেত্রে প্রথম পর্বে ৪৩ ব্যক্তি ও ২টি প্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৮ ব্যক্তি ও ৫টি প্রতিষ্ঠানসহ ৬১ ব্যক্তি এবং ৭টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়। যাতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-সাংসদ বা রাজনীতিবিদ ও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়নি। তবে নাম এসেছে- আবদুল আউয়াল মিন্টু, নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, তাবিথ আউয়াল, তাফসির আউয়াল, তাজওয়ার মো. আউয়াল ও তাদের মালিকানাধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আর বাকিরা হলেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী, যাদের অনেকে বাংলাদেশিই নন। ভুয়া নাম পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। এছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশে ব্যবসা করা বিদেশিদের নামও।
উল্লেখ্য, দেশে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের দায়েও আব্দুল আউয়াল মিন্টু পরিবার সম্পৃক্ত। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে দুদকের বেশ কিছু মামলা চলমান রয়েছে। অর্থ পাচারকারী হিসেবে প্যারাডাইস ও প্যান্ডোরা পেপার্সে আসা মিন্টু ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয় ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি।
দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণে দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন মিন্টু। তবে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের বিলাসী জীবনের জন্য গোপনে টাকা পাঠানো বন্ধ ছিলনা। রাজনীতি ছেড়ে বুড়ো বয়সে (৭৪) ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিও নেন মিন্টু। কিন্তু হঠাৎ গর্ত থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মুখ খুলেছেন। দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সোচ্চার, বড় বড় লেকচারও দিচ্ছেন গণমাধ্যমে। অথচ প্যান্ডোরা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় মিডিয়ার সামনে মুখ খোলার সৎসাহস ছিলনা তার। ভেবেছেন এতদিনে সবাই অতীত ভুলে গেছে। তাই এখন মাথা তুলে বেরিয়ে এসেছেন আর দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। বিচার করারও কথা বলছেন। কয়লা ধুলেও কি ময়লা যায়? মিন্টু পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো কেন থমকে আছে, দেশবাসী জানতে চায়। রাম নাম জপে সাধু সাজা এই ভূতের বিচার হওয়া দরকার সবার আগে।