চোরের মা-বাবার বড় গলা : দুর্নীতি নিয়ে বিএনপির বাগাড়ম্বর

বাংলা প্রবাদ বলে, আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে। অর্থাৎ, কোনো কিছু নিয়ে অন্যকে সবক দেওয়ার আগে নিজের সংশোধন জরুরি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তার দল বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রতিদিনই মাইকের সামনে গলাবাজি তার করতেই হয়, এটাই তার চাকরি। লন্ডন থেকে তাকে এই দায়িত্বই দেওয়া হয়েছে। চাবি দেওয়া পুতুলের মত প্রতিদিন তার কাজ একটাই- সরকারের সমালোচনা করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলা। মিথ্যা বলায় পটু এই বিএনপি নেতা গণমাধ্যমের সামনে অপপ্রচারের ঝাঁপি খুলে বসেন। যদিও দিনকয়েক আগে বলেছিলেন- বর্তমান সরকারকে নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। কিন্তু মুখ তার বন্ধ হয়নি, ননস্টপ চলছে। দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার তিনি। এমনভাবে কথা বলেন, যে কারো মনে হবে ফখরুল এবং তার দল বিএনপি বোধহয় দুধে ধোয়া তুলসী পাতা! তার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো এমন- সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত, ক্ষমতাসীনরা আজ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, ব্যাপক দুর্নীতিতে সরকারের অস্তিত্ব ইতোমধ্যেই কলঙ্কিত, এমপি আনারের মৃত্যুর পেছনে দুর্নীতি-লুটপাটের সম্পর্ক আছে, বর্তমান সরকার চোরের রাজা বাটপার- ইত্যাদি। বক্তব্যে মনে হচ্ছে যেন কোনো সাধুপুরুষ জাতিকে নসিহত করছেন!

অথচ এই মির্জা ফখরুল নিজেই ছিলেন এক মহা দুর্নীতিবাজ। কৃষি প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সার, সেচের জ্বালানীসহ সমগ্র কৃষিখাতে চরম অদক্ষতা ও অযোগ্যতার পরিচয় দেন ফখরুল। দলের ভেতরেই ব্যাপক চাপের মুখে ফখরুলকে প্রত্যাহার করে বিমান-এ আনেন খালেদা জিয়া। বিমান প্রতিমন্ত্রী ফখরুলের অযোগ্যতায় সৈয়দপুর বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যায়। সেখানকার রাডার স্টেশন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়, যা আর ঠিক করাননি। রাজশাহী বিমানবন্দরেও অপারেশনাল কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, বরিশাল বিমানবন্দরে বিমান চলাচল কমে যায়। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে দেশের বিমানবন্দরগুলোর শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে। বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকে সুবিধা দিতে বাংলাদেশ বিমানের অধিকাংশ বিমানই গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়। বিমান-এর নিজস্ব ৫টি ডিসি-১০ এর মধ্যে ৪টিই অচল, ডিসি-১০-এর ১০টি ইঞ্জিন মেরামতের নামে বছরের পর বছর বিদেশে ফেলে রাখা হয়। ৫টির মধ্যে ৪টি ডিসি-১০ বিকল থাকায় মাত্র ৩টি সচল বিমানের ওপর চাপ পড়ে। ফলে বিমান-এর সমস্ত শিডিউল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

মির্জা ফখরুলের সময় নিউইয়র্কে নর্থ আটলান্টিক ট্রাভেল এজেন্সিজ নামে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের একটি ট্রাভেল সিন্ডিকেট কাজ করত। ফখরুল বিমান-এর নিউইয়র্ক শাখাকে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিলেন বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের ওই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ছাড়া অন্যরা যেন বিমান-এর টিকেট বিক্রি করতে না পারে। সেই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্কের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া আদায় করত। ফলে ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বাংলাদেশ বিমান-এর যাত্রী কমতে শুরু করে। তাদের অতি লোভ ও কালোবাজারির কারণে একপর্যায়ে বিমানের ঢাকা-নিউইয়ের্ক রুটের ফ্লাইটই বন্ধ করে দিতে হয়। (সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ, ২২শে জানুয়ারি ২০১৩)। এই মির্জা ফখরুল এখন দুর্নীতি নিয়ে বড় বড় লেকচার দেন। আর তার দল বিএনপির দুর্নীতির ইতিহাস তো বাংলাদেশের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, সকল কৃতিত্ব খালেদা জিয়া সরকারের:

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই)-এ পরপর ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত আমলে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো, মন্ত্রী-সাংসদ ও প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে লজ্জাজনক এই পরিচিতি পায় বাংলাদেশ। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্র, জোট সরকারের এমপি-মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়। সেসময়কার দুর্নীতির মামলায় খালেদা-তারেকদের সাজা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরা হলো।

তারেক রহমান- দুর্নীতির বরপুত্র। যার সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট কল্পকথাকেও হার মানিয়েছে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবনে বসে তারেক বিকল্প সরকার ও মাফিয়া সাম্রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। তারেকের ব্যবসায়িক জীবন শুরু ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত নৌ পরিবহনের দুটি ব্যবসা ছাড়াও আরো অন্তত ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার বাস্তব কোনো অস্তিত্বই ছিল না। জিয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠা করা এই কাল্পনিক প্রতিটি কোম্পানির নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ নেয়া হয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকার। দুর্নীতির অর্থকে বৈধ দেখাতে এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান থেকে আয়ও দেখানো হতো। তারেক তার বন্ধু ও পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুনের নামে ১৯৯৪ সালে শিল্পঋণ সংস্থার প্রতিষ্ঠান তাজ ডিস্টিলারিজ নামমাত্র ১৬ কোটি টাকা মূল্যে কিনে নেন। যদিও কাগজপত্রে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নাম লেখা হয় আবদুল্লাহ আল মামুন হিসেবে। এই ক্রয়ে সরকারের ক্ষতি হয় অন্তত ১১ কোটি টাকা।

২০০১ সালের নির্বাচনে তারেকের আশীর্বাদে বিএনপিপন্থী কয়েকজন ব্যবসায়ী মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন পান। নিজের পছন্দে কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী নির্বাচন করেন তারেক। যাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। বড় অংকের সরকারি সব কেনাকাটা হতো তারেকের মাধ্যমে। সরকারী কোনো দায়িত্বে না থাকলেও অলিখিত সরকারপ্রধান হিসেবে পরিচিত পান তারেক। যার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হাওয়া ভবন। তারেক, মামুন, খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দার ও শামীম ইস্কান্দারদের এই সিন্ডিকেটের কাছে অর্থ উপার্জনই হয়ে ওঠে মুখ্য। রহমান শিপার্স থেকে ক্রমে প্রতিষ্ঠা পায় রহমান গ্রুপ, ওয়ান গ্রুপ, রহমান নেভিগেশন, চ্যানেল ওয়ান, ডান্ডি ডায়িং, ইউনিটেক্স অ্যাপারেলস, ক্রিমেন্টাইন লিমিটেড, ক্রোনোটেক্স লিমিটেড, তুরাগ ফিশারিজ, তাজ ডিস্টিলারিজ, দৈনিক দিনকালসহ নামে বেনামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

বিশ্লেষকরা বলেন, জিয়া পরিবারের দুর্নীতি-অনিয়মের খতিয়ান যতটুক জানা গেছে, তা মোট অপকর্মের ৫ ভাগও নয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে এসব অর্থ পাচার ও বিনিয়োগ করা হয়েছে নামে-বেনামে। ফলে এসবের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার উপায় নেই। তারেক তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের মাধ্যমে গায়েবি কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সরকারি কেনাকাটার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। এমনকি নিজদলীয় কোনো নেতার প্রতিষ্ঠান সরকারি প্রকল্পের কাজ করলেও তারেক রহমানকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের কমিশন। ফলে তারেকের নামই হয়ে গিয়েছিল মি. টেন পার্সেন্ট! জার্মান প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স-এর সব প্রকল্পে তারেক রহমানকে ঘুষ দিতে হয়েছে ২% হারে। চীনের হার্বিন কোম্পানিকে একটি প্রকল্পের কাজ পেতে তারেককে ঘুষ দিতে হয়েছিল ৭,৫০,০০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম কনস্ট্রাকশনকে একটি কাজ পেতে তারেককে দিতে হয়েছিল ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, কাউকে পৃথিবীছাড়া করার মত ব্যাপারও টাকার বিনিময়ে দফারফা করতেন তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার সম্মতিতে বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তা সাব্বির হত্যায় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছ থেকে নেন ১০০ কোটি টাকা। টাকাটা লেনদেন হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এর হাত দিয়ে।

সরকারের সমান্তরালে হাওয়া ভবনের মাফিয়া সরকার, রাষ্ট্রের সকল স্তরে অল তারেক’স মেন:

বিএনপি-জামায়াত আমলে খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রীসভা থাকলেও কার্যত দেশ চালাতো তারেক এবং তার অধীনস্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা। সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন খালেদার নিয়োগকৃত, অপরজন তারেকের আজ্ঞাবহ। এভাবেই সাজানো হয়েছিল সব মন্ত্রণালয়। ৮৬ ও ৮৮ সালে বিমানবন্দরে স্মাগলিংয়ের দায়ে দুবার গ্রেপ্তার হওয়া চোরাকারবারি সর্দার লাগেজ বাবর ওরফে ক্যাসিও বাবর ওরফে লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন ওই সময়ে তারেকের সবচেয়ে বড় চমক। আমান উল্লাহ আমান, ফজলুর রহমান পটল, ব্যরিস্টার আমিনুল হক, হারিছ চৌধুরীসহ অসংখ্য আজ্ঞাবহ নেতা তারেকের ছায়াতলে আসেন। আমলা ও সচিব পদেও বসানো হয় নিজস্ব লোকজন। অভিযোগ, এই আজ্ঞাবহদের সবাইকে তারেকের ছায়াতলে ঠাঁই পেতে চাহিদা অনুসারে মালপানি দিতে হয়েছিল।

প্রশাসনে পদোন্নতি, টেন্ডার, নিয়োগ বা সরকারি চুক্তি- সবক্ষেত্রেই কমিশন বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসব চলে ৫ বছর। ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বত্র ১০% ব্যবস্থা চালু হয়। হাওয়া ভবনে ১০% দিলে মরা গাছও প্রাণ ফিরে পায়- এমন কথা চালু ছিল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারেক সিন্ডিকেটের নজর পড়ে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর। সাংবাদিক সম্মেলনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভারতীয় টাটা কোম্পানি বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ করবে, এতে বাংলাদেশ বদলে যাবে। তবে টাটা সেই প্রকল্প বাতিল করে। কারণ, ৫ হাজার কোটি কমিশন দাবি করেছিলেন তারেক ও মামুন। হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। তাই বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগসহ সব ক্ষেত্রে নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের বসানো হয়। প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ছাড়া অন্যদের বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর বা অব্যাহতি দেওয়া হয় তারেকের মাফিয়া সরকার টিকিয়ে রাখা এবং দুর্নীতির পথ সুগম করার স্বার্থে। সেনাবাহিনীতেও চালানো হয় শুদ্ধি অভিযান। সেনা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নিজস্ব আজ্ঞাবহ লোকদের পদোন্নতি দিয়ে উচ্চপদে বসানো হয়। আজ্ঞাবহ ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি করতে সংবিধানও সংশোধন করা হয়। এরপরেও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে ২১শে আগস্টের নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়।

‘প্রিন্স অব বগুড়া’ প্রতিবেদন, খলিল-তারেকের শত্রুতা মুছে গেল যেভাবে:

সিএনএন ও ডেইলি স্টারে কর্মরত সাংবাদিক তাসনিম খলিলের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তারেকের সাগরসম দুর্নীতি, জঙ্গিবাদে মদদ ও জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়ায় ‘প্রিন্স অব বগুড়া’ নামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জঙ্গি নেতাদের সাক্ষাৎকার ও তথ্য-প্রমাণ নিয়ে প্রতিবেদন করেন খলিল। যাতে রাষ্ট্রীয় কয়েকটি নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদেরও নাম উঠে আসে। এতে ক্ষুব্ধ হন তারেক ও তার অনুগতরা। যার প্রেক্ষিতে খলিলকে গ্রেপ্তার এবং ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় অভিযোগ করা হয়,পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছেন খলিল। এরপর আন্তর্জাতিক কয়েকটি ছদ্মবেশি মানবাধিকার সংস্থা- যাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন দেশে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে- সেসব সংস্থার চাপের মুখে তাসনিম খলিলকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। খলিলকে সাথে নিয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বাসায় তার ঘনিষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের গোপন বৈঠক হয়। খলিলকে কিছু শর্তও দেওয়া হয়। সেসব শর্তে রাজি হলে স্ত্রীসহ দেশত্যাগের সুযোগ পান খলিল। রাতারাতি বিদেশি সংস্থাগুলোর সহায়তায় দেশ ছাড়েন খলিল।

বিদেশে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন গুজব কারখানা- নেত্র নিউজ। বিভিন্ন দেশের সরকার উৎখাতে সম্পৃক্ত এনইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত নেত্র নিউজে যুক্ত হন ডেভিড বার্গম্যান। সাথে আছেন বিএনপিপন্থী গুজব রটনাকারী ও জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ায় বহিষ্কৃত কিছু সেনা সদস্য, কিছু বিতর্কিত প্রতারক সাংবাদিক এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থী ইউটিউবাররা। আর এই চক্রের পেছনে রয়েছেন তারেক রহমান। যে তারেকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করে চরম নির্যাতিত হয়েছিলেন খলিল, যে তারেকের কারণে খলিলের ক্রসফায়ার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, সেই তারেকের সাথে মিলেমিশে কাজ করছেন এখন খলিল। অর্থাৎ কত বিপুল অর্থ লুটে নিয়েছিলেন তারেক ক্ষমতায় থাকতে, যার কত বড় ভাগ পেয়েছেন খলিল, যাতে নিজের প্রাণের শত্রুর সাথেও তিক্ততা ভুলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা সম্ভব- এটা কি অনুমান করা সম্ভব?

জার্মান টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি সিমেন্স থেকে কোকোর ঘুষ গ্রহণ:

খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেয়ার কথা আদালতে স্বীকার করে সিমেন্স। বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাব উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ৮ই জানুয়ারি সম্পত্তি জব্দের মামলা হয়। ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। কোকো সিমেন্স ও চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে তার অ্যাকাউন্টে ঘুষ হিসেবে নিয়েছিল ওই টাকা। মার্কিন বিচার বিভাগ কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার মামলা করে। কারণ তার সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কিছু টাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল। কোকোর অ্যাকাউন্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই মার্কিন ডলারে সেই ঘুষের টাকা পরিশোধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিদেশ থেকে ঘুষ ও জোরপূর্বক টাকা আদায় করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে।

মামলার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোকোর অ্যাকাউন্টের লেনদেন হয় বিদেশে বসে এবং ঘুষ ও জোরপূর্বক তিনি ওই অর্থ নেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোকোর ওই অর্থ জব্দ করে, তাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কোকোর সিমেন্স ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে কাজ করে। কোকো জাসজ (ZASZ) নামে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির নামে ঘুষের অর্থ জমা করে, যা তার পরিবারের সদস্যদের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত। (Z হলো যাফ্রিয়া- কোকোর বড় মেয়ের নামের আদ্যাক্ষর, A হলো আরাফাত রহমান কোকোর নিজের নামের আদ্যাক্ষর, S হলো কোকোর স্ত্রী শর্মিলার নামের আদ্যাক্ষর এবং Z হলো যাহিয়া- কোকোর ছোট মেয়ের নামের আদ্যাক্ষর)। কোকো ঘুষের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন, এমন প্রমাণ পেয়ে সে দেশের সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারকে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দেয়। এর আগে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে কোকোকে বাংলাদেশের একটি আদালত ২০১১ সালে ৬ বছরের জেল দেয়। কোকোর নামে সিঙ্গাপুরে ফেয়ারহিল নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলা হয়। এ মামলায় তাকে আরও ৫.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল।

তারেকের অর্থপাচার সিন্ডিকেট:

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তারেক ও তার ঘনিষ্ট বন্ধু মামুনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানি লন্ডারিং নিয়ে তদন্ত করে। বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্যও দিয়ে যান এফবিআই’র বিশেষ প্রতিনিধি। তদন্তে উঠে এসেছে, তারেক ও মামুন তাদের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক এবং চীনের হার্বিন ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশনের এদেশিয় এজেন্ট খাদিজা ইসলাম থেকে সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নেয়। হার্বিনের লোকাল এজেন্ট হিসেবে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেতে তারেক ও মামুনকে ওই টাকা দেওয়া হয় ঘুষ হিসেবে। এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ এ বিষয়ে তারেক ও মামুনের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেন। তিনি বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দেন, খাদিজা ইসলাম সিঙ্গাপুরে মামুনের সিটি ব্যাংকে (অ্যাকাউন্ট নাম্বার: ১৫৮০৫২-০১৬-০০৮) ওই টাকা জমা দেন। ওই একই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারেকের নামে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড (নাম্বার: ৪৫৬৮-৮১৭০-১০০৬-৪১২২) ইস্যু করা হয়। সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংক থেকে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড নিতে তারেক তার পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দেন (তারেকের পাসপোর্ট নাম্বার: Y ০০৮৫৪৮৩)। যেখানে তার পিতা- জিয়াউর রহমান এবং মাতা- বেগম খালেদা জিয়া লেখা রয়েছে। তারেক এই কার্ড গ্রিস, জার্মানী, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেন। এমন তথ্য পাওয়া যায় এফবিআই’র তদন্তে।

এভাবে মোয়াজ্জেম হোসাইন ও মারিনা জামান ঘুষের টাকা মামুনের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেন, যে অ্যাকাউন্টে তারেকের সরাসরি লেনদেন ছিল। ২১শে জুলাই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তারেককে ৭ বছরের জেল এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানা করে মানি লন্ডারিংয়ের জন্য। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, এ ধরণের অপরাধমূলক কাজ ‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইম’ এবং এমন কাজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা। মামুনের অ্যাকাউন্টে খাদিজা ইসলামের দেয়া ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলারে খোঁজ পেয়ে সুপ্রিম কোর্ট তারেক সম্পর্কে মন্তব্য করেন ওই টাকাটা ঘুষের টাকা বলে। যদিও আদালতে তারেক ও মামুনের আইনজীবীরা এই টাকাকে পরামর্শক ফি হিসেবে দেখিয়েছেন। অথচ দুজনের কারোই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে পরামর্শক হওয়ার মত কোনো যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা কিছুই নেই।

নাইকো দুর্নীতি:

২০১১ সালেল ২৩শে জুন কানাডার আদালত খালেদা জিয়ার জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের দুর্নীতি মামলার উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিল। মোশাররফ কানাডার কোম্পানী অনৈতিক সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে একটি দামি গাড়ি উপহার নেন নাইকো থেকে। যার আর্থিক মূল্য ছিল সেসময় কানাডিয়ান ডলারে ১,৯০,৯৮৪ ডলার। নাইকো আরও ৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার ঘুষ দেয় মোশাররফকে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য। নাইকো বাংলাদেশ থেকে নিজেদের ঠিক করা দামে গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে এবং গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হলে সরকারের নির্ধারিত জরিমানা আরো কমিয়ে দেয়া হবে- এটা নিশ্চিত করতেই মোশাররফকে ঘুষ দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৪শে আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট রিট পিটিশনের (পিটিশন নাম্বার: ৫৬৭৩) রায় দেয়। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, এফবিআই এবং দুদকের সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত রায় দেয়, ২০০৩-০৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে নাইকো থেকে বড় ধরণের ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার নামে। নাইকোর এই ঘুষ দেয়ার কাজটি নির্লজ্জের মতো বলে অবজার্ভেশন দেয় সুপ্রিম কোর্ট। নাইকো তাদের এজেন্ট কাশিম শরীফকে ৪ মিলিয়ন ডলার ও ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভুঁইয়াকে ৫ লাখ ডলার দেয় পরামর্শক হিসেবে, যেন তারা বিএনপি সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এসব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে কানাডিয়ান পুলিশ এবং এফবিআই। তথ্য-প্রমাণ বলে, নাইকো তাদের বাংলাদেশি এজেন্টদেরকে সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথমে বার্বাডোজের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কাশিম শরীফ ও সেলিম ভুঁইয়ার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকাগুলো দেয়। পরে ওই টাকা চলে যায় তারেকের বন্ধু মামুনের অ্যাকাউন্টে। যার অংশীদার তারেক নিজেই।

এফবিআই’র বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষ্য:

এফবিআই এজেন্ট ডেবরা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে দুর্নীতি হয়েছিল তা নিয়েই তিনি তদন্ত করেছেন। ২০১৬ সালের ২১শে নভেম্বর আদালতে তারেক ও মামুনের বিরুদ্ধে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন সেখানে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং জিয়া পরিবার নিয়ে মন্তব্য করেন। বিএনপি সরকার এবং জিয়া পরিবারের কারণে কীভাবে দেশজুড়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি হয়েছিল তা তিনি তুলে ধরেন। গ্রিফিথের মন্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

“কিছু ‘পরামর্শক’ এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া হয়, যারা অর্ধ ঐ সকল সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে পৌছে দেন। মামুন ও তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিম, দুইজনই তারেক রহমান ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ক্ষমতাসীনদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে টাকা স্থানান্তর করে। যারা পরে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ঘুষদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়। বাংলাদেশে কাজ করতে ইচ্ছুক অনেক প্রতিষ্ঠান এই মধ্যস্ততাকারীদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিতো, যাদের মূলত টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল-গ্যাস ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। ক্ষমতাশীলদের সাথে সুসম্পর্ককে ব্যবহার করে ঘুষ লেনদেন করতো। কয়েকজন আমার কাছে এই বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন, বাংলাদেশে যেকোনো কাজ পেতে প্রতিষ্ঠানটিকে মামুন বা তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিমকে টাকা দিতে হতো, যারা পরে সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলে তারেক ও কোকোর কাছে পৌঁছে দিতেন। আমরা যতগুলো দুর্নীতির মামলার তদন্ত করেছি, সব তদন্তেই এটা প্রমাণিত। আরও প্রমাণ হয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ছাড়াও নিচুপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারাও ঘুষের ভাগ পেতেন। যেমন, সিমেন্স দুর্নীতি মামলার তদন্তে সিঙ্গাপুরে কোকোর ঘুষের ব্যাপারে সে দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা একটি অফিসে তল্লাশি চালান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওয়ারিদ টেলিকমের কোকোকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি ‘পরামর্শক চুক্তি’র কাগজও খুঁজে পান। অথচ টেলিকম খাতে কোকোর কোন দক্ষতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রমাণ নেই এবং পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতাও নেই। কোকো আরব আমিরাতে বাড়ি কেনেন এবং সেখান থেকে টাকা তার সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করার তথ্য আমার তদন্তে উঠে আসে।”

তারেক রহমানের দুর্নীতি সম্পর্কে উইকিলিকসের চাঞ্চল্যকর নথি:

উইকিলিকসের নথিতে তারেক রহমানের দুর্নীতি-অপকর্ম নিয়ে বিপুল নথিপত্র আছে। তাতে উঠে এসেছে গোপন তথ্য। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ২০০৮ সালের ৩রা নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এক গোপন তারবার্তায় তারেক সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠান। যা পরে উইকিলিকসে ফাঁস হয়। মরিয়ার্টির পাঠানো সেই গোপন বার্তায় ‘বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের কুখ্যাত বড় ছেলে এবং মায়ের উত্তরসূরি’, ‘ভয়ঙ্কর রাজনীতিক এবং দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতাসম্পন্ন সরকারের প্রতীক’ উল্লেখ করে তাকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। মরিয়ার্টির রিপোর্টে তারেককে খালেদা জিয়ার বদমাশ এবং ভয়ঙ্কর পুত্র আখ্যায়িত করেন। তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিনিময়ে দেশের মন্ত্রীত্ব বিক্রির অভিযোগও করা হয়। বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন ও নির্বাচনে জয়লাভে কৌশলগত বুদ্ধি প্রয়োগের কৃতিত্ব তার। ৬০ জনের মন্ত্রিপরিষদের এক-তৃতীয়াংশ পদই তার আজ্ঞাবহদের কাছে বিক্রি করেছেন। সমালোচকরা বলেন, তারেক খুবই নির্দয় ও দুর্নীতিবাজ। যার পড়াশোনাও বেশিদূর নয়, রাজনীতিতে অপরিপক্ক। ‘হাওয়া ভবন’ নামে একটি বাড়ি থেকে তিনিই মূলত সরকারের সরকার ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল তার ‘ছায়া সরকার’।

প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির ওই রিপোর্টে বলা হয়, সমালোচকরা তাকে (খালেদা) অলস, অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে দলের মূল ক্ষমতা তার হাতেই।

উইকিলিকসের নথিতে মরিয়ার্টি ছাড়াও কূটনীতিক হ্যারি কে টমাস, প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, গীতা পাসি প্রমুখের বরাত দিয়ে এসেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি, অপকর্ম, সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন বিষয়। নথির এসব তথ্যের অনেক কিছুই দেশের গণমাধ্যমের লোকজন জানতেন। যদিও বিরাগভাজন হওয়ার শঙ্কায় বড় বড় মিডিয়া হাউজ এসব এড়িয়ে গেছে।

২০১১ সালে প্রকাশিত উইকিলিকসের আরেক নথিতে জানা যায় কীভাবে অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই’র খাস সাগরেদ কামারুলকে (মাহতাব খামারু) তারেকের টেলিফোন পেয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় র‌্যাব! নথি বলছে- সরকারি ক্রয় ও রাজনৈতিক নিয়োগে ঘুষ নিতেন তারেক। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও কর ফাঁকির অনেক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তিনি মুক্তি পান। সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে গভীর আঁতাতের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ায় কারসাজির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার জামিন আটকাতে যে চেষ্টা করেছিল, তা পেরোতে সক্ষম হন তারেক। দুদক তার বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি ডলার অর্জনের দায়ে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলাও রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে বলে উইকিলিকসে ফাঁসকৃত মার্কিন নথির বরাতে জানা যায়।

এ ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি মার্কিন কোম্পানি সিমেন্স কেলেঙ্কারির ঘটনাটিও তুলে ধরেন তার সেই রিপোর্টে। সিমেন্সের চুক্তির কাজের মোট অর্থ থেকে ২% ঘুষ নেন তারেক। যা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করা হয়। মামলাটি মার্কিন বিচার বিভাগ এবং এফবিআই’র তদন্তাধীন ছিল। দুদকের বরাতে মরিয়ার্টির রিপোর্টে বলা হয়, এসব ঘুষ ও চাঁদাবাজির বাইরেও তারেক ব্যাপক অর্থ তছরুপে জড়িত ছিলেন। কয়েকজন সহচরের মাধ্যমে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ফান্ডের ৩ লাখ ডলার আত্মসাৎ করেন। মরিয়ার্টি আরও বলেন, তারেক ছিলেন ওই তহবিলের সহ-স্বাক্ষরদাতা। ওই ফান্ডের অর্থ দিয়ে তিনি নিজ শহরে একটি জমি কিনেছেন। এছাড়া ওই তহবিলের অর্থ তিনি ২০০৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির সদস্যদের মধ্যেও বিলি করেছেন। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মধ্যে ছিল আরেক ‘ছায়া সরকার’। হাওয়া ভবনে বসে এ সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন দল ও জোটের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েক নেতা। এমন বহু অপকর্মের খতিয়ান মিলেছে উইকিলিকসের সেই নথির পাতায় পাতায়! মরিয়ার্টির রিপোর্টের ভিত্তিতেই তারেককে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য বিপজ্জনক, সেদেশে প্রবেশের অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়।

জিয়া পরিবারের অপর সদস্যদের নামে দুর্নীতির মামলা:

যেসব মামলায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তার বাইরেও খালেদা, তারেক এবং বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন। যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আমলে নতুন কোনো দুর্নীতির মামলা হয়নি।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা- জিয়াউর রহমানের নামে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেন করেন খালেদা, তারেকসহ অভিযুক্তরা।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা- খালেদা, তারেকসহ অভিযুক্ত আরও ৪ জন অরফানেজ ট্রাস্টের নামে এতিমদের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আসা ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকার অনুদান আত্মসাৎ করে।

বড়পুকুরিয়া খনি দুর্নীতি মামলা- খালেদাসহ ১৬ জন অভিযুক্ত। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কন্ট্রাক্টর নিয়োগে অভিযুক্তরা ১৫৯ কোটি টাকা ঘুষ নেন।

গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা- খালেদা জিয়াসহ ১৪ জন অভিযুক্ত। চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ গ্যাটকোকে দেওয়ায় রাষ্ট্রের ১৪৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

নাইকো দুর্নীতি মামলা- খালেদা জিয়াসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়েছে।

লন্ডনে তারেকের বিলাসী জীবন, নেই কোনো নির্দিষ্ট আয়:

১/১১’র পর দেশ থেকে মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে লন্ডনে পালিয়ে কিংস্টনের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তারেক। আকারে বাড়িটি ছোট হওয়ায় একই সড়কে নতুন একটি বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন। যার মূল্য ১৫ লক্ষ পাউন্ড। বর্তমানে আরও বিলাসবহুল আরেকটি বাড়ি কিনেছেন হোয়াইট রিজে। যার মূল্য ৪৫ লক্ষ পাউন্ড। তারেকের সঙ্গে স্ত্রী জোবাইদা ও কন্যা জাইমা থাকেন সেখানে। তাদের পরিবারে রয়েছে ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি। তারেকের ছোট ভাই প্রয়াত কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমানও নিজের মেয়েদের নিয়ে মালয়েশিয়া ছেড়ে লন্ডনে বসবাস করছেন। তারাও থাকেন কিংস্টনের আরেকটি বিলাসবহুল বাড়িতে।

দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা বলেন, তারেকের বিলাসবহুল জীবন-যাপনের অর্থ যায় বাংলাদেশ থেকে। দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটির জন্যও টাকা দিতে হয় তারেককে। তিনি সন্তুষ্ট হলে অনুমোদন পায় কমিটি। আগে ছিল নির্বাচনী মনোনয়নও। এখন যুক্ত হয়েছে বহিষ্কার বাণিজ্য। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের নামে বহিষ্কার করেন নেতাদের, তারপর টাকা দিলে সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। কর্মীদের অভিযোগ, বিএনপিতে ফ্রি বলে কিছু নেই। লন্ডনে যে যত বেশি অর্থ পাঠাতে পারবেন, দলে তার অবস্থান ততই মজবুত। বিভিন্ন চ্যানেলে অর্থ পৌঁছে যায় লন্ডনে। মিডিয়া হিসেবে কাজ করেন ব্যবসায়ী ও বিশ্বস্ত নেতারা। যদিও তারেক ট্যাক্স রিটার্ন পেপারে উল্লেখ করেছেন, আয়ের উৎস ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা। অনলাইনে বেটিং অ্যাপের মাধ্যমে জুয়া খেলে অর্থ উপার্জন করেন বলে দাবি তার।

পরিশেষে:

২০শে নভেম্বর, ১৯৬৭ সালে জন্ম নেয়া তারেক রহমান বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কর্তৃক হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। ২৪ জনকে হত্যা এবং আরও অগুণিত মানুষকে হত্যার প্রচেষ্টায় ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি- হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের একজন তারেক রহমান। বিশ্বের অন্যতম সভ্য দেশ যুক্তরাজ্যে ‘পলাতক’ অবস্থায় সবার চোখের সামনে আরামে দিন কাটাচ্ছে এই ঘৃণ্য খুনি। সেখানে বসে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। অসাম্প্রদায়িক, শান্তিকামী রাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরীর জন্য অর্থায়ন ও উস্কানি দিচ্ছেন। তারেক রহমানকে শীঘ্রই বাংলাদেশে এনে আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি সাধারণ মানুষের।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Facebook
WhatsApp
Telegram
Twitter
LinkedIn
Email
Print

আরও পড়ুনঃ

মালিক হত্যা মামলার দ্রুত বিচারের দাবিতে মৌলভীবাজারে স্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি মৌলভীবাজারের রাজনগরে

অবশেষে খাসি সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান প্রশাসনের সহায়তায় হচ্ছে

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি খাসি সম্প্রদায়ের

ভোলার চর কুকরি মুকরিতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

মো: সামিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধ ভোলার চরফ্যাশন

মৌলভীবাজারের সন্তানের স্বপ্ন পূরণ হলো না! বেলারুশ সীমান্তে পিটিয়ে হত্যা

তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি স্বপ্ন পূরণে ইচ্ছা ছিল

মৌলভীবাজার পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক মহিম গ্রেপ্তার

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি বৈষম্যবিরোধী মামলায়

নিয়ামতপুর উপজেলায় বি,এন,পি দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

এম,এ,মান্নান,নিয়ামতপুর(নওগাঁ) প্রতিনিধি নওগাঁ জেলার

জয়চন্ডী ইউপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিলন বৈদ্য

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া

কমলগঞ্জে এক শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে

প্রধান সংবাদ

মায়েদের উৎসাহিত করতে ভোলায় মা সমাবেশ

মোঃ সামিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি ভোলা সদর উপজেলার

ভোলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের সমাপনি

মোঃ সামিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি ভোলায় প্রতিবন্ধী

কুয়াকাটায় এক ইলিশের দাম উঠলো প্রায় ৭ হাজার টাকা

উপজেলা প্রতিনিধি, কলাপাড়া(পটুয়াখালী) পটুয়াখালীর

উড়ছে বি এন পি নেতার খোলা চিঠি !

মোঃ রাওফুল বরাত বাঁধন ঢালী, লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম জেলার

হাসিনার প্রসাশনিক এজেন্টরা ইউনূস সরকারকে সফলে বাঁধা;রিজভী

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব

জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ এর সমাবেশে মানুষের ঢ়ল

এম,এ,মান্নান, নিয়ামতপুর, নওগাঁ নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর

উপকূলে মাঝারি বৃষ্টিপাত, ০৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল

মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে পটুয়াখালীসহ উপকূলীয়